Introduction to Culture and Imperialism - Edward Said – Translation in Bengali (Part 3 of 3) |
Introduction to Culture and Imperialism - Edward Said – Translation in Bengali (Part 3 of 3)
আমি
বিশ্বাস করি না যে, লেখকেরা ভাবাদর্শ, শ্রেণি, বা অর্থনৈতিক ইতিহাস দ্বারা যান্ত্রিকভাবে
নির্দেশিত হন, বরং আমার বিশ্বাস, তারা খুব বেশি করে তাদের সমাজের ইতিহাসের ভেতরে থেকে
আলাদা আলাদা পরিমাণে ঐ ইতিহাস আর সামাজিক অভিজ্ঞতার নির্মাণ করেন ও নির্মিতি লাভ করেন। সংস্কৃতি ও এর অন্তর্গত
নান্দনিক রূপসমূহ আকরিত হয় ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা থেকে যা বস্তুত এই বইয়ের
প্রধান
বিষয়বস্তুগুলোর অন্যতম। ওরিয়েন্টালিজম লেখার সময় আমি যেমনটা আবিষ্কার করেছিলাম,
তালিকা বা সারণি দিয়ে ঐতিহাসিক অভিজ্ঞান হৃদয়ঙ্গম করা যায় না। আর অনুসন্ধানের পরিধি
যত ব্যাপক হোক না কেন, কিছু বইপত্র, প্রবন্ধ, লেখক ও ভাবনা সবসময় বাইরে রয়ে যায়
বা পক্ষান্তরে, আমি যা করেছি তাকে পরিচালিত করেছে নির্বাচনশীলতা এবং সচেতন বাছবিচার
এটা পূর্বাহ্নেই স্বীকার করে নিয়ে যা কিছুকে আমি গুরত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য মনে করেছি
সেদিকে দৃষ্টি দিতে চেষ্টা করেছি। আমার আশা, এই বইয়ের পাঠক ও সমালোচকেরা এর অন্তর্ভুক্ত
সাম্রাজ্যবাদের ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা সম্পর্কে অনুসন্ধানরেখা ও যুক্তিসমূহের প্রসার ঘটাতে
একে ব্যবহার করবেন। প্রকৃতপক্ষে যা একটি বৈশ্বিক প্রক্রিয়া তার আলোচনা ও বিশ্লেষণে আমাকে কখনো সখনো সাধারণীকৃত ও সারসংক্ষিপ্ত হতে হয়েছে, তারপরও,
আমি নিশ্চিত, কেউই আশা করত না যে বইটি এর বর্তমান কলেবরের চেয়ে বড়ো হোক।
উপরন্তু,
আরো কতগুলো সাম্রাজ্য রয়ে গেল যেগুলোর আলোচনা আমি করিনি। অস্ট্রো-হাঙ্গেরীয়, রুশ,
অটোমান এবং হিস্পানি ও পর্তুগিজ সাম্রাজ্যসমূহ। এই ব্যত্যয়গুলোর অর্থ এই নয় যে, মধ্য
এশিয়া ও পূর্ব ইউরোপের রুশ আধিপত্য, আরব ভূমিতে
ইস্তাম্বুলের শাসন, আজকের অ্যাঙ্গোলা ও মোজাম্বিকে পর্তুগালের এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয়
ও লাতিন আমেরিকার দ্বীপপুঞ্জে হিস্পানি আধিপত্য হয় সদাশয় (সে কারণে অনুমোদিত) অথবা
তুলনায় কম সাম্রাজ্যবাদী ছিল। ইঙ্গ-ফরাসি-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী অভিজ্ঞতা নিয়ে আমি
যা বলতে চেয়েছি তা হচ্ছে এর একটি অনন্য সংলগ্নতা এবং এক বিশেষ সাংস্কৃতিক কেন্দ্রিকতা
বর্তমান। অবশ্যই ইংল্যান্ড স্বয়ং একটি সাম্রাজ্যবাদী শ্রেণির প্রতিভূ, আমাদের তুলনায়
বৃহত্তর, আরো জাঁকালো এবং আরো কর্তৃত্বব্যঞ্জক। প্রায় দুশো বছর যাবৎ ফ্রান্সের সাথে
প্রত্যক্ষ প্রতিদ্বন্দ্বিতায় শামিল ছিল। যেহেতু সাম্রাজ্যবাদী অভিযাত্রায় আখ্যানের (কাহিনী – নাটক, উপন্যাস, গল্প, কাব্য সব) ভূমিকা উল্লেখযোগ্য,
সেহেতু এটা বিস্ময়কর নয় যে ফ্রান্স
ও (বিশেষত) ইংল্যান্ডের রয়েছে উপন্যাস রচনাশিল্পের এক অব্যাহত ও তুলনারহিত ঐতিহ্য। উনবিংশ শতকে আমেরিকা
সাম্রাজ্য হিসাবে অভিহিত হয়। কিন্তু বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে, ব্রিটিশ ও ফরাসি
সাম্রাজ্যের বি-উপনিবেশায়নের পর এটা সরাসরি দুই বৃহৎ পূর্বসূরির পথ অনুসরণ করে।
এই তিনটের উপর নজর ফেরানোর পক্ষে আরো দুটো কারণ রয়েছে।
একটা হলো সাগরপারের শাসনের ধারণা-সংলগ্ন এলাকা ডিঙিয়ে বহুদূরবর্তী ভূমিতে উল্লম্ফনের
একটা অনুকূল অবস্থিতি আছে এই তিন সংস্কৃতিতেই। এই ধারণা কার্যকর করতে উপস্থাপনার বিস্তারিত
ভূমিকা রয়েছে, হোক তা কথাসাহিত্যে, ভূগোলে অথবা শিল্পকলায়; এবং প্রকৃত সম্প্রসারণে,
প্রশাসনিক কর্মকাণ্ডে, বিনিয়োগে ও প্রতিশ্রতিতে তা এক প্রবহমান উপস্থিতি অর্জন করে।
সুতরাং ব্রিটেনের, ফ্রান্সের, এবং অন্যভাবে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদী
সংস্কৃতিতে নিয়মানুগ কোনো ব্যাপার আছে যা সেইরকমভাবে অন্যদের ক্ষেত্রে দেখা যায় না।
আমি এটাই মাথায় রাখি যখন ‘মনোভাব ও সম্পর্কসূত্রের কাঠামো’-এই শব্দবন্ধটি ব্যবহার করি। দ্বিতীয়ত, এই তিন দেশ হলো তারাই
যাদের কক্ষপথে আমার জন্ম, বেড়ে ওঠা এবং বর্তমান অধিবাস। যদিও আমি এদের কোলে
স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি, তবু রয়ে গেছি আরব ও মুসলিম বিশ্ব থেকে আগত এক নেটিভ হয়ে যে
অপরপক্ষেরও অধিকারভুক্ত। এই ব্যাপারটা এক অর্থে আমাকে সক্ষম করেছে দুদিকেই বাস করতে
এবং উভয়ের মধ্যে সংযোগ স্থাপনে চেষ্টিত হতে।
পরিশেষে,
এই গ্রন্থ অতীত ও বর্তমান সম্বন্ধীয়, ‘আমরা ও তারা সম্বন্ধীয়
যেরূপ এদের প্রত্যেক অভিধাকে বিচিত্র এবং সাধারণভাবে পৃথক ও পরস্পরবিরোধী পক্ষগুলো
যেভাবে দেখে থাকে। সেই অর্থে এর সময়কাল হলো ঠান্ডা লড়াইয়ের পরবর্তী সময় যখন যুক্তরাষ্ট্র
বিশ্বের একমাত্র পরাশক্তিরূপে আবির্ভূত হয়েছে। এরকম একটা সময়ে আরববিশ্বে প্রোথিত
পশ্চাদপটধারী একজন শিক্ষাবিদ ও বুদ্ধিজীবীর পক্ষে সেখানে বাস করার অর্থ ভিন্ন ভিন্ন
অনেকগুলো উদ্বেগ যাদের সবগুলোই এই গ্রন্থকে ঝাঁকিয়েছে। যেহেতু ওরিয়েন্টালিজম প্রকাশিত
হবার পর থেকে আমি যা-ই কিছু লিখেছি তাতে তাদের প্রভাব রয়েছে। প্রথমত, এক হতাশাজনক
বোধ যে আমেরিকান পলিসির বর্তমান সংগঠন সম্পর্কে আগেও পড়া ও দেখাশুনা হয়েছে। বৈশ্বিক
আধিপত্যকামী প্রতিটি মহানাগরিক কেন্দ্র একই ধরনের অনেক কথা বলে আর তদ্রুপ
কাজ করে। ক্ষুদ্রতর জনগোষ্ঠীকে শাসনের ক্ষেত্রে ক্ষমতা ও জাতীয় স্বার্থের আবেদন এখনও
কার্যকর; যখন ব্যাপার একটু অমসৃণ হয়ে ওঠে, অথবা যখন নেটিভেরা বিদ্রোহী হয়ে সাম্রাজ্যবাদী
শক্তির ফাঁদে পড়ে দায়িত্ব নেয়া বশংবদ কোনো অজনপ্রিয় শাসককে প্রত্যাখ্যান করে, তখন
সেই একই ধ্বংসসাধক উদ্দীপনা লক্ষিত হয়; সেই একই ভয়ানকভাবে অনুমানযোগ্য ঘোষণা যে,
‘আমরা
ব্যতিক্রমী, সাম্রাজ্যবাদী নই, পূর্ববর্তী শক্তিগুলোর ভুলের পুনরাবৃত্তি করতে আমরা
অনিচ্ছুক, এমন এক ঘোষণা যা রটিনমাফিক পুনরাবৃত্ত হচ্ছে ভুলগুলো সহকারে যার সাক্ষী ভিয়েতনাম
ও উপসাগরীয় যুদ্ধ। আরো খারাপ হলো যদিও প্রায়শ অক্রিয় তবু বুদ্ধিজীবী, শিল্পী,
সাংবাদিকদের পক্ষে চমকপ্রদ পরস্পর সহযোগিতা দেশে যাদের অবস্থান প্রগতিশীল এবং প্রশংসনীয়
আবেগে পরিপূর্ণ কিন্তু দেশের বাইরে তাদের নামে যা হয় তার প্রসঙ্গ আসলে সেই অবস্থান
ঠিক উল্টে যায়।
আমার বিশ্বাস
(হয়তো অসার) যে সাম্রাজ্যবাদী অভিযাত্রার সাংস্কৃতিক অভিধাসংবলিত ইতিহাস অতএব কিছু
বিশদ ও এমনকি প্রতিবন্ধক উদ্দেশ্যসাধন করতে পারে হয়তো। তারপরও যদিও উনিশ ও বিশ শতকে
সাম্রাজ্যবাদ অব্যাহত গতিতে এগিয়েছে, তবে প্রতিরোধও এগিয়েছে। তাহলে পদ্ধতিগতভাবে
আমি এই দুই শক্তিকে একত্র করে দেখাতে চেষ্টিত। এটা কোনোভাবেই সংক্ষুব্ধ উপনিবেশায়িত
লোকদেরকে সমালোচনার বাইরে রাখছে না যেহেতু উপনিবেশোত্তর স্থিতি সোধিত যে কোনো জরিপে
প্রকাশ পাওয়া জাতীয়তাবাদের সম্ভাবনা ও অপসম্ভাবনা, যাদেরকে বিচ্ছিন্নতাবাদ ও প্রাদেশিকতা
বলে অভিহিত করা চলে, সবসময়ই তৃপ্তিদায়ক গল্পের জন্ম দেয় না। ইদি আমিন এবং সাদ্দাম
হুসেনের বিকল্প যে সবসময়েই ছিল শুধু তা দেখাতে গেলে এটাও বলতে হয় অবশ্যই। পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ ও তৃতীয় বিশ্বের জাতীয়তাবাদ একে অপরের পুষ্টিসাধন করেছে,
কিন্তু সবচেয়ে খারাপ দশাতেও এরা একশিলা কিংবা নিয়ন্ত্রণবাদী নয়। আবার সংস্কৃতিও একশিলা নয়, নয় তা প্রাচ্য বা প্রতীচ্যের না নরনারীর
ছোটো ছোটো দলের একচেটিয়া সম্পত্তি।
সবকিছুর
পরও গল্পটি ম্রিয়মাণ এবং প্রায়শ অনুদ্দীপক। আজ একে
যা শক্তি যোগাচ্ছে তা হলো, এখানে সেখানে বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক বিবেকের জাগরণ। এটা
ছিল দ্বিতীয় চিন্তা যা থেকে নির্মিত হয়েছে এই গ্রন্থ। যাহোক, এরকম বিলাপ খুব শোনা
যায় যে, মানবিকীবিদ্যা পাঠসংক্রান্ত পুরোনো পন্থা শিকার হয়েছে রাজনৈতিক চাপের, যাকে
বলা হয়েছে নালিশের সংস্কৃতি তার উপর, “পশ্চিমা” কিংবা “নারীবাদী” অথবা “আফ্রিকাকেন্দ্রিক” এবং “ইসলামকেন্দ্রিক” মূল্যবোধের যা এখন আর পূর্বাবস্থায় নেই, তার সম্বন্ধে যত
রকমের গুরতরভাবে অতিবৃত অভিযোগের উপর। উদাহরণস্বরূপ, ধরন মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক পঠনপাঠনে
ঘটে যাওয়া অসামান্য পরিবর্তন-যে অঞ্চল আমার ওরিয়েন্টালিজম রচনাকালীন সময়েও এক দুর্দান্ত রকম
পরস ও সমঝোতাপ্রবণ নীতির বশংবদ ছিল। গত তিন-চার বছরে প্রকাশিত মাত্র কয়েকটি গ্রন্থ
যথা, লীলা আবু লুঘোদ-এর ভেইল্ড সেন্টিমেন্টস, লাইলা আহমেদ-এর উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার
ইন ইসলাম, ফেদ্বা ম্যাল্টি ডগলাস-এর উইমেন্স বডি, উইমেন্স ওয়র্ল্ড-দের উল্লেখ করে
বলা যায়, ইসলাম, আরব ও মধ্যপ্রাচ্য সম্পর্কে এক ভীষণ আলাদারকমের ধারণা পুরোনো স্বৈরতন্ত্রকে
চ্যালেঞ্জ করেছে এবং বেশ ভালোরকম দুর্বল করে দিয়েছে। এই রচনাকর্ম নারীবাদী কিন্তু বর্জনবাদী
নয়। এগুলো প্রাচ্যবাদ ও মধ্যপ্রাচ্যীয় জাতীয়তাবাদের সংশ্লেষক ডিসকোর্সসমূহের পশ্চাদভূমিতে
ক্রিয়াশীল অভিজ্ঞানের বৈচিত্র্য ও জটিলতাকে তুলে ধরে। এগুলো বুদ্ধিবৃত্তিক ও রাজনৈতিক-উভয়ভাবে
বাস্তববোধসম্পন্ন, সেরা তাত্ত্বিক ও ঐতিহাসিক পাণ্ডিত্যে অনুরণিত, অভিনিবিষ্ট কিন্তু
খবরদারিবর্জিত, নারীর অভিজ্ঞতার প্রতি সংবেদী কিন্তু ভাবোচ্ছাসে ভেসে যাওয়া নয়। শেষ
কথা, এগুলো যেমন ভিন্ন ভিন্ন পশ্চাদপট ও শিক্ষাবিশিষ্ট পণ্ডিতদের রচনা, তেমনি মধ্যপ্রাচ্যের
নারীদের রাজনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে সংলাপে ব্যবস্থিত ও তাতে অবদান রাখছে।
যদিও এগুলো
ভারত ও মধ্যপ্রাচ্যের সমরূপ ক্রমহাসমান বোধগম্য অঞ্চল হিসেবে গৃহীত ভূগোলকে ভেঙে টুকরো
না করে ফেললেও সারা সুলেরির - দি রেটোরিক অব ইংলিশ
এবং লিজা লোয়ের - ক্রিটিকল টেরেইন-এর হাত ধরে এ ধরনের সংশোধনবাদী
পাণ্ডিত্যে বৈচিত্র্য এনেছে। জাতীয়তাবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী প্রকল্পের প্রিয় বাইনারি
অপজিশনের বিলুপ্তি ঘটেছে। বদলে আমরা দেখতে শুরু করেছি যে, নতুন নেতৃত্ব যেনতেনভাবে
পুরোনো নেতৃত্বকে কেবল স্থানচ্যুত করছে না, আরও সীমানা, ধরণ, জাতি, এবং সত্তার মাঝে
নবশ্রেণিকরণ দ্রুতই দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। এই নতুন শ্রেণিবিন্যাসগুলোই
পরিচয়ের স্থৈতিক ধারণা যা ইউরোপীয় ও তাদের ‘অপর’দের মধ্যকার অন্তঃসার
তাকে উস্কানি দিচ্ছে ও চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। আমরা আর ‘তারা বলে কিছু আছে-অর্ধশতাব্দীকাল
পূর্বে চালু হওয়া এবং প্রায় অপরিবর্তিত থাকা এই ধারণা, যাদের প্রত্যেকে নির্ধারিত,
পরিষ্কার, ও অপ্রতিহতভাবে স্বপ্রকাশী। ওরিয়েন্টালিজম-এ
যেমনটি আলোচনা করেছি, এই বিভাজন বর্বরদের সম্পর্কে প্রাচীন গ্রিক ধারণার সমান পুরোনো,
তবে যে-ই এ-ধরনের পরিচয়দাতা ভাবনার জন্ম দিয়ে থাকুক না কেন, উনবিংশ শতক নাগাদ এই
ধারণা সাম্রাজ্যবাদী ও ইউরোপের শৃঙ্খল প্রতিরোধের চেষ্টায় রত সংস্কৃতিসমূহের নির্দেশক
চিহ্ন (hallmark) হয়ে ওঠে।
আমরা এখনও সেই ঠাটের উত্তরাধিকার বহন করে চলেছি যাতে
জাতির দ্বারা কারো পরিচয় স্থিরীকৃত হয়। জাতির কর্তৃত্ব অর্জিত হয় তথাকথিত অখণ্ড
ঐতিহ্য থেকে। সাংস্কৃতিক পরিচয় সম্বন্ধে এই চিন্তা কোনো গ্রন্থ বা কোনো কর্তৃপক্ষ
আমাদের সংস্কৃতি নির্মাণ করে তা নিয়ে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে এক প্রতিযোগিতার সৃষ্টি
করেছে। সাধারণভাবে, এই কিংবা ওই গ্রন্থটি আমাদের ঐতিহ্যের অংশ (অথবা নয়)-এটা কল্পনাযোগ্য
সবচাইতে দুর্বলকারী চর্চা। তাছাড়া, ঐতিহাসিক যাথার্থে অবদানের তুলনায় এর বাড়াবাড়িই
বেশি উপলব্ধ। আরবের লোকদের যে শুধু আরবি বই পড়তে হবে এবং আরবি পদ্ধতি অনুসরণ করতে
হবে-এমত প্রয়োজন যে-ধারণায় তার প্রতিক্রিয়াকে যতখানি উপেক্ষা করতে পারি, আমাদের যে
শুধুমাত্র অথবা প্রধানত, ‘আমাদের যা কিছু তা নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হবে-এই
অবস্থানের প্রতি আমার উপেক্ষা তার চেয়ে বেশি নয়।
সি.এল.আর. জেমস যেমনটি বলতেন, বীঠোফেন যতটা জার্মানদের ততটাই তিনি ওয়েস্ট-ইন্ডিয়ানদের,
যেহেতু তাঁর সঙ্গীত এখন মানবতার ঐতিহ্যের অংশ।
তার পরও
পরিচয়ের মতাদর্শগত অনুধ্যান বোধগম্যভাবে জড়িয়ে গেছে নানা দলের স্বার্থ ও কর্মসূচির
সঙ্গে-সকল দলই শোষিত সংখ্যালঘু নয়-যারা এইসব স্বার্থের অনুকূলে
প্রাধান্যের স্থান নির্দেশ করতে পারে। যেহেতু এই গ্রন্থের বিশাল অংশ সাম্প্রতিক ইতিহাসের
যা পাঠ করতে হবে এবং যেভাবে পাঠ করতে হবে সে সম্বন্ধিত, আমি এখানে শুধু আমার ধারণাগুলোকে
দ্রুত সারসংক্ষিপ্ত করব। আমেরিকান পরিচয়ের ধারণার বিষয়ে একমত হবার পূর্বে আমাদের
মানতে হবে যে, বিবেচনাযোগ্য পরিমাণ দেশি উপস্থিতির ধ্বংসাবশেষের উপরে আপতিত এক অভিবাসী
সমাজ হিসেবে মার্কিন পরিচয় একক ও সমসত্ত্ব হওয়ার পক্ষে দারা বৈচিত্র্যময়। সত্যিই
ভেতরের লড়াইটা হলো একক পরিচয়ের প্রবক্তাদের সাথে তাদের যারা একে সামগ্রিকভাবে জটিল
তবে হ্রাসমানভাবে সমন্বিত নয়-এরকম মনে করেন। এই বিরোধ ইঙ্গিত দেয় দুটি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গির,
দুটি ইতিহাস যাদের একটি একরৈখিক ও অন্তগ্রাহী, অপরটি কন্ট্রাপুন্টাল ও প্রায়শ পরিযায়ী।
আমার যুক্তি
হলো, শুধুমাত্র দ্বিতীয় দৃষ্টিভঙ্গি ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার বাস্তবতার প্রতি সংবেদী। খানিকটা
সাম্রাজ্যের দরুণ সকল সংস্কৃতিই পরস্পরের
সঙ্গে সম্পৃক্ত; কেউ একক ও অবিমিশ্র নয়, সকলেই সংকর, নানাধর্মী, অসাধারণভাবে বৈচিত্রায়িত,
এবং অসমসত্ত্ব। আমি বিশ্বাস করি, এটা সমকালীন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ততটই সত্য যতটা সত্য
তা আধুনিক আরব বিশ্বের জন্য, যেখানে যথাক্রমে উভয়ের জন্য ‘অ-মার্কিনত্ব’ এর বিপদ এবং ‘আরবত্ব’-এর প্রতি হুমকি সম্পর্কে অনেক কিছু বলা
হয়েছে। হায়, শিক্ষার খোদ বুনটের মধ্যে যত্রতত্র রক্ষণাত্মক, প্রতিক্রিয়াশীল, আর
এমনকি বিকারগ্রস্ত জাতীয়তাবাদ বোনা থাকে, যাতে শিশুদের সাথে সাথে আরো বয়স্ক ছাত্রদের
(সাধারণভাবে এবং উস্কানিমূলকভাবে অন্যদের বিনিময়ে) তাদের সংস্কৃতির অনন্যতাকে সম্মান
করতে ও এর উদযাপন করতে শেখানো হয় । এই
সকল সমালোচনা-নিস্পৃহ এবং চিন্তাবিযুক্ত শিক্ষারীতি ও দর্শনের
প্রতিই এই গ্রন্থ নির্দেশিত-এক শোধনকারী, এক ধৈর্যশীল প্রতিবর্ত, ও অকপটভাবে অনুসন্ধাব্রতী
এক সম্ভাবনা হিসেবে। এর রচনাকালে আমি গ্রহণ করেছি সেই ইউটোপীয় স্থান যা দিয়ে রেখেছে
বিশ্ববিদ্যালয় যাকে, আমার বিবেচনায়, এমন জায়গা হয়ে থাকতে হবে যেখানে এরকম জরুরী বিষয়সকল উদ্ভূত, আলোচিত, ভাবিত হয়। যেখানে রাজনৈতিক বিষয়াবলি
আরোপিত কিংবা সাব্যস্ত হয় শুধু—এমন স্থান হয়ে ওঠা এর পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয়ের
কার্যাবলির অবলেপন এবং নিজেকে ক্ষমতায় আসীন রাজশক্তির সংযোজনমাত্র করে তোলা হবে।
আমি চাই
না যে আমাকে ভুল বোঝা হোক। অসাধারণ সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য সত্ত্বেও যুক্তরাষ্ট্র এক
সংহত রাষ্ট্ররূপে রয়েছে এবং নিশ্চিতভাবে ভবিষ্যতেও থাকবে। অন্যান্য ইংরেজি-ভাষী রাষ্ট্র
(ব্রিটেন, নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা) সম্পর্কেও একথা সত্য, এমনকি ফ্রান্সও,
যেখানে রয়েছে অভিবাসীদের বড় বড় দল। দ্য ডিজইউনাইটিং অব আমেরিকা গ্রন্থে আর্থার শ্লেসিংগার
ইতিহাসের পঠনকে আহতকারী ইতিহাসের বিতর্কমূলক বিভেদ এবং মেরচ কৃত বিতর্কের যে কথা বলেছেন তা অবশ্যই বর্তমান, কিন্তু আমার মতে, তা
প্রজাতন্ত্রের বিলোপনের ভবিষ্যদ্বাণী করে না। মোটের উপর, ইতিহাসকে দমিত করা কিংবা প্রত্যাখ্যান
করার চেয়ে এর মধ্যে অনুসন্ধান করা ভালো। যুক্তরাষ্ট্রে যে বহুসংখ্যক ইতিহাস রয়েছে
আর অনেকগুলোই মনোযোগ আদায়ের জন্য চিৎকার করছে এই বাস্তবতাকে ভয় পাওয়ার কোনো কারণ
নেই, কেননা আগে থেকেই
এদের অনেকগুলোই
বর্তমান ছিল এবং প্রকৃতপক্ষে এদের থেকে মার্কিন সমাজ ও রাজনীতির (এমনকি ইতিহাসমূলক
রচনার এক শৈলীরও) উদ্ভব হয়েছে। অন্য কথায়, বহুসংস্কৃতিবাদ নিয়ে বর্তমান বিতর্কে
ফল কদাচ “লেবাননীকরণের মতো কিছু,
আর এইসব বিতর্ক যদি রাজনৈতিক পরিবর্তনের প্রতি, এবং যেভাবে নারীরা, সংখ্যালঘুরা, ও
সাম্প্রতিক অভিবাসীরা নিজেদেরকে মূল্যায়ন করে সেদিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করে, তবে তাতে
ভয় পাওয়া বা তাকে প্রতিরোধ করার দরকার পড়ে না। যেটা মনে রাখা দরকার তাহলে স্বাধীনতা
কিংবা আলোকায়নের আখ্যানসমূহ তাদের সবচেয়ে শক্তিমান আবরণে
বিচ্ছিন্নয়নের নয়, একত্রীকরণের আখ্যানমূল দল থেকে পূর্বে বিতাড়িত কিন্তু এখন সেখানে
জায়গা পেতে সংগ্রামরত লোকদের কাহিনি এসব। মূল দলের অভ্যাসগত ধারণাবলি নতুন দলগুলোর
অন্তর্ভুক্তির ব্যাপারে যদি যথেষ্ট নমনীয় বা সহিষ্ণু না হয়, তাহলে এইসব ধারণায় আনা
দরকার পরিবর্তন যা উদীয়মান দলগুলোকে প্রত্যাখ্যান করার চেয়ে অনেক ভালো একটা কাজ।
শেষ যে
কথাটা আমি বলতে চাই তাহলে এই গ্রন্থটি এক নির্বাসিতের গ্রন্থ। যাদের উপর আমার হাত ছিল
না এরকম বাস্তব কিছু কারণে আমি পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত আরব হিসেবে বেড়ে উঠেছি। যখনকার
কথা স্মরণ করতে পারি, তখন থেকেই বোধ করেছি যে আমি নিরঙ্কুশভাবে দুটো দুনিয়ার যে কোনো
একটির না হয়ে দুটোরই আপনার। আরবের যে অংশগুলোর সঙ্গে আমি বেশি একাত্ম ছিলাম তারা আমার
জীবদ্দশাতেই হয় গণঅভ্যুত্থান ও গৃহবিবাদে পুরোপুরি বদলে গেছে, অথবা সোজা কথায়, অস্তিত্ব
হারিয়েছে। আর সুদীর্ঘকাল ধরে যুক্তরাষ্ট্রে-বিশেষত, যখন তা গভীরভাবে আরববিশ্বের (এটিহীনতা
থেকে সুদূরবর্তী) সংস্কৃতি ও সমাজের বিরোধী ছিল ও এদের সঙ্গে যুদ্ধে জড়িয়েছিল-আমি
ছিলাম বহিরিস্থিত। তবু যখন বলি ‘নির্বাসিত তখন আমি দুঃখিত বা বঞ্চিত কোনো
কিছুকেই বুঝাই না। বিপরীতক্রমে, সাম্রাজ্যবাদী বিভাজনরেখার
দু'পাশেই তথাচরিত লগ্ন থাকাটা উভয়কে আরো সহজে হৃদয়ঙ্গম করতে আপনাকে সাহায্য করে।
অধিকন্তু, এই গ্রন্থের সবটাই যেখানে লিপিবদ্ধ হয়েছে সেই নিউ ইয়র্ক বহুপন্থায় উচ্চতম ঘরানার নির্বাসিতের নগরী; এটা আরো নিজের মধ্যে
ফার্নো-বর্ণিত মেনিকীয় সংগঠন ধারণ করে। হয়তো এসবই এখানে প্রযুক্ত বিবিধ আগ্রহ ও ব্যাখাসমূহকে
উস্কে দিয়েছে, কিন্তু এইসব পরিস্থিতি আমার এরকম ভাবনাকে সম্ভব করে তুলেছে যে, আমার
অধিভুক্তি একাধিক ইতিহাস এবং একাধিক দলে। এরকম অবস্থা একটিমাত্র সংস্কৃতির অধিভুক্ত
থাকা আর একটিমাত্র জাতির প্রতি আনুগত্যের বোধ ধারণ করার সাধারণ ধারণার সত্যিকার প্রশংসাযোগ্য
বিকল্প হতে পারে কি না তার বিচার এখন অবশ্যই করবেন পাঠক।
- - - - - - - - - END - - - - - - - - - -
No comments:
Post a Comment