Total Pageviews

Thursday, July 2, 2020

Introduction to Culture and Imperialism - Edward Said – Translation in Bengali (Part 2 of 3)

Introduction to Culture and Imperialism - Edward Said – Translation in Bengali (Part 2 of 3)

Introduction to Culture and Imperialism - Edward Said – Translation in Bengali (Part 2 of 3)
এভাবে এমনকি যখন ডিকেন্স অস্ট্রেলিয়াজনিত সমস্যার সমাধান করছেন, তখনও প্রাচ্যের সাথে বাণিজ্য ও পর্যটন মাধ্যমে ব্রিটেনের সাম্রাজ্যবাদী কর্মকাণ্ডের প্রতি ইঙ্গিতবাহী ধারণা ও সূত্রের আরেক কাঠামো আবির্ভূত হয়। উপনিবেশী বণিকের নতুন পেশায় পিপ কদাচ একটি ব্যতিক্রমী চরিত্র, কেননা ডিকেন্সের প্রায় সকল বণিক, পথভ্রষ্ট আত্মীয়বর্গ, ভীতিকর বহিরিস্থিতগণ সকলেরই মোটামুটি স্বাভাবিক এবং নিরাপদ সংযোগসূত্র রয়েছে সাম্রাজ্যের সঙ্গে। কিন্তু মাত্র সাম্প্রতিক বছরগুলোতেই এই যোগসূত্রগুলো ব্যাখ্যামূলক গুরত্ব পেতে শুরু করেছে। পণ্ডিত ও সমালোচকদের এক নতুন প্রজন্ম-কোনো ক্ষেত্রে বি-উপনিবেশায়নের সন্তানেরা, স্বদেশে মানবিক মুক্তির উন্নয়নের ফলভোগীরা (যেমন লৈঙ্গিক, ধর্মীয়, ও বর্ণভিত্তিক সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী) পশ্চিমা সাহিত্যের ওইরকম মহৎ রচনার মধ্যে তথাকথিত বর্ণগ্রস্ত অধমর্ণ জনতা অধ্যুষিত অধমর্ণ এক জগৎকে এমন উন্মুক্তভাবে বর্ণনা করার প্রতি একটা সদাজাগ্রত আগ্রহ দেখতে পান যাতে অসংখ্য রবিনসন ক্রুসোর আগমন ও হস্তক্ষেপ সেখানে ঘটতে পারে। 
উনবিংশ শতকের শেষে এসে সাম্রাজ্য আর কোনো ছায়াচ্ছন্ন উপস্থিতি নয়, অথবা শুধু পলাতক আসামির অগ্রহণযোগ্য উপস্থাপনায় আকরিত নয়, বরং কনরাড, কিপলিং, জিদ এবং লোটি প্রমুখের রচনার কেন্দ্রীয় গুরত্বের স্থান। আমার দ্বিতীয় উদাহরণ, কনরাডের নোস্ত্রমো (১৯০৪)। এর আখ্যান স্থাপিত হয়েছে মধ্য আমেরিকার এক প্রজাতন্ত্রে যা স্বাধীন (কনরাডের পূর্ববর্তী উপন্যাসগুলোর মতো পূর্ব-এশিয়ার উপনিবেশী প্রতিবেশ নয়), এবং একই সময়ে বাইরের আগ্রহ দ্বারা প্রবলভাবে প্রভাবিত-কারণ এর বিপুল রৌপ্যখনি। এসময়কার কোনো মার্কিনীর জন্য এই রচনার সবচেয়ে আকর্ষক বিষয় হলো কনরাডের দূরদর্শিতা। তিনি লাতিন আমেরিকার প্রজাতন্ত্রগুলোর অনপনেয় অশান্তি ও অপশাসনের ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন (বলিভারকে উদ্ধৃত করে তিনি বলেছেন, এদের শাসন করা সাগরে লাঙল দেয়ার শামিল) এবং নিশ্চিত অথচ প্রায় লক্ষ্যের অগোচরে পরিস্থিতিকে প্রভাবিত করার উত্তর আমেরিকান কৌশলকে তিনি আলাদা করে চিহ্নিত করেন। স্যানফ্রান্সিসকোর অর্থলগ্নিকারী হলরয়েড যিনি স্যান তোমে খনির মালিক চার্লস গৌল্ডের পৃষ্ঠপোষক, তিনি তাঁর পোষ্যকে সাবধান করে বলেন, লগ্নিকারী হিসেবে আমরা খুব বড়ো বিপদে পড়ব না। তার 
পরও 
-আমরা অপেক্ষা করে দেখতে পারি। ঠিকই আমরা কখনো এতে ঢুকব, ঢুকতে আমরা বাধ্য। কিন্তু তাড়াহুড়োর কিছু নেই। খোদার দুনিয়ার মহত্তম দেশে স্বয়ং সময়কে অপেক্ষায় স্থির থাকতে হয়েছে। আমরা সবকিছুর জন্যই কথা দেবো-শিল্প, বাণিজ্য, আইন, সাংবাদিকতা, কলা, রাজনীতি আর ধর্ম নিয়ে-কেপ হর্ন থেকে সুরিথের আওয়াজ পর্যন্ত এবং তার ওপারেও যদি উত্তর মেরাতে অধিকার করার উপযুক্ত কোনো কিছু দেখা যায়। তারপর আমরা অবসর পাব পৃথিবীর প্রান্তবর্তী দ্বীপসমূহ আর মহাদেশগুলো হস্তগত করতে। আমরা বিশ্বের বাণিজ্য চালাব বিশ্ব তা পছন্দ করুক আর না করুক। বিশ্ব একে রুখতে পারে না-বোধ হয় আমরাও না।
ঠান্ডা লড়াই শেষ হবার পর এর ইঙ্গিতপূর্ণ আত্মপ্রশংসা, অনবগুণ্ঠিত বিজয়েচ্ছা, দায়িত্বশীলতার গম্ভীর আত্মবিঘোষণসহ মার্কিন সরকার প্রণীত নতুন বিশ্বব্যবস্থার ভাষাভঙ্গির অনেকখানিই কনরাডের হলরয়েড প্রকাশ করতে পারত: আমরা এক নম্বর, আমরা নেতৃত্ব দিতে বাধ্য, আমরা মুক্তি ও শৃঙ্খলার প্রতীক এবং আরো অনেক কিছু। কোনো মার্কিনী এই ভাবনা সংগঠনে প্রতিস্পর্ধী নয়, এবং এর পরেও কনরাডের হলরয়েড ও গৌল্ড চরিত্রের মধ্যে সমাহিত সাবধানবাণী সম্পর্কে কদাচিৎ ভেবে দেখা হয়, যেহেতু ক্ষমতার বাগর্থ সাম্রাজ্যের পশ্চাদ্ভূমিতে প্রযুক্ত হলে তা খুব সহজেই পরার্থপরতার বিভ্রম উৎপাদন করে। কিন্তু এটা এমন একটা বাগর্থ যার সবচেয়ে প্রাণঘাতী বিশেষত্ব হলো এই যে, একে আগেও ব্যবহার করা হয়েছে, একবার মাত্র নয় (স্পেন ও পর্তুগালের দ্বারা), তবে বধিরকারী মাত্রার পুনরাবৃত্তিতে এই আধুনিককালে ব্রিটিশ, ফরাসি, বেলজীয়, জাপানি, রুশ এবং বর্তমানে মার্কিনীদের দ্বারা। 
তবু, ফলের মুক্তবণিক, কর্নেল, স্বাধীনতাকামী শক্তি এবং মার্কিন অর্থে চালিত ভাড়াটে সেনাবাহিনীর সূত্রজালে বিশ শতকের লাতিন আমেরিকায় যা ঘটতে দেখি তার আগাম বর্ণনামাত্র হিসেবে কনরাডের এই মহৎ সাহিত্যকৃতিকে যদি পাঠ করি তবে তা খণ্ডিত পাঠ হবে। কনরাড তৃতীয় বিশ্ব সম্পর্কে পাশ্চাত্যের ধারণার পূর্বসূরি, যে তৃতীয় বিশ্ব এ্যায়েম গ্রীন, ভি. এস. নইপল, রবার্ট স্টোন-এদের মতো বিচিত্র ধরনের ঔপন্যাসিকের কর্মে, হানা আরেন্ট-এর মতো সাম্রাজ্যবাদী তাত্ত্বিকের লেখায়, আরো ভ্রমণ কাহিনিকার, চলচ্চিত্রকার ও তর্কপ্রিয়দের কর্মে, যাদের বিশেষত্ব হলো বিচার বিশ্লেষণের জন্য কিংবা ইউরোপীয় বা উত্তর আমেরিকার অদ্ভুত রুচির তৃপ্তিসাধনের জন্য অ-ইউরোপীয় বিশ্বের বর্ণনা করা। কেননা, যদিবা এটা সত্যি হয় যে, কনরাড স্যান তোমের রৌপ্যখনির ব্রিটিশ ও মার্কিন মালিকদের সাম্রাজ্যবাদকে শ্লেষাত্মকভাবে তাদের নিজেদের উচ্চাকাঙ্ক্ষার মধ্যে কারারদ্ধরূপে দেখেছেন, তবে এ-ও তো সত্যি যে, তিনি লেখক হিসেবে এমন একজন মানুষ অপশ্চিমা বিশ্ব সম্পর্কে যাঁর পাশ্চাত্য দৃষ্টিভঙ্গি তাঁর মধ্যে এতটাই বদ্ধমূল যে তা তাঁকে অন্যান্য ইতিহাস, সংস্কৃতি, উচ্চাকাঙ্ক্ষার প্রতি অন্ধ করে রাখে। কনরাড শুধু যা দেখতে পান তাহলে আটলান্টিকের পারের পাশ্চাত্যভূমি দ্বারা শাসিত এক বিশ্ব যাতে প্রতিটি পাশ্চাত্যবিরোধ পাশ্চাত্যের দুষ্ট ক্ষমতার নিশ্চিত স্বীকৃতি প্রদান করে। তিনি যা দেখতে পান না তাহলো এই ক্রুর দ্বিরক্তির কোনো অনুকল্প। তিনি এটাও বোঝেননি যে ভারত, আফ্রিকা, এবং দক্ষিণ আমেরিকারও নিজেদের জীবন ও সংস্কৃতি বিদ্যমান, যা পরদেশী সাম্রাজ্যবাদী বা বিশ্বহিতসাধকদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নয়, আবার নিজেকে এটাও বুঝতে দেননি যে, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলন পুরোটাই দুর্নীতিগ্রস্ত নয় কিংবা লন্ডন ও ওয়াশিংটনের সূত্রধর-কর্তাদের বেতনে চালিত নয়। দৃশ্যকল্পের এইসব গুরতর সীমায়ন চরিত্র ও আখ্যানভাগের মতোই নোস্ত্রমো-র অবিচ্ছেদ্য অংশ। গৌল্ড ও হলরয়েড-এর মততা চরিত্রের মাধ্যমে ব্যঙ্গ করা হয়েছে যে সাম্রাজ্যবাদকে তার সেই একই পুরষতান্ত্রিক অহমিকা কনরাডের উপন্যাসে অঙ্গীভূত। কনরাড মনে হয় বলতে চান, কে ভালো আর কে খারাপ নেটিভ তার মীমাংসা করব আমরা পশ্চিমারা, কেননা আমাদের শনাক্তকরণের দরুন সকল নেটিভের যথেষ্ট অস্তিত্ব বিদ্যমান। আমরা তাদের নির্মাণ করেছি, কথা বলতে ও চিন্তা করতে শিখিয়েছি, আর যখন তারা বিদ্রোহ করে, তখন তারা শুধু তাদের সম্পর্কে আমাদের যে ধারণাঅর্থাৎ, তাদের পশ্চিমা মালিকদের কারো কারো দ্বারা বোকা বনে যাওয়া সরলমতি শিশুসকল-তাকে সপ্রমাণ করে। বাস্তবে দক্ষিণী প্রতিবেশীদের সম্বন্ধে মার্কিনীরা যা ভাবে তা হলো: স্বাধীনতা তাদের জন্য ততক্ষণ পর্যন্ত কাম্য যতক্ষণ সেটা সেই প্রকারের স্বাধীনতা যাকে অনুমোদন করি।
এর বাইরে যে কোনো কিছু অগ্রহণযোগ্য এবং, আরো খারাপ অর্থে, অচিন্ত্যনীয়।' সুতরাং এটা কোনো ব্যতিচার নয় যে, কনরাড যুগপৎ সাম্রাজ্যবাদবিরোধী এবং সাম্রাজ্যবাদী ছিলেন; যখন সাগরপারের শাসনযন্ত্রের স্বপ্রকাশ ও আত্মবিভ্রমকর দুর্নীতিকে ভীতিহীনভাবে এবং নেতিবাচকভাবে প্রকাশের প্রয়োজন তখন তিনি প্রগতিশীল, আর ভীষণ প্রতিক্রিয়াশীল, যখন এটা স্বীকার করার দরকার হয় যে, আফ্রিকা বা দক্ষিণ আমেরিকার কখনো একটি স্বাধীন ইতিহাস বা সংস্কৃতি ছিল যাকে সাম্রাজ্যবাদীরা ভয়ানকভাবে ঘটিয়েছে কিন্তু শেষপর্যন্ত যার দ্বারা তারা পরাস্ত হয়েছিল। তবে কনরাডকে তার সময়ের সন্তান বলে ধরে নেয়ার আগে লক্ষ্য করা দরকার যে, ওয়াশিংটন এবং বেশিরভাগ পশ্চিমী নীতিনির্ধারক ও বুদ্ধিজীবীর সাম্প্রতিক মনোভাব তাঁর মতামতের বিষয়ে সামান্যই আগ্রহ দেখায়। সাম্রাজ্যবাদী মানবহিতৈষণা তত্ত্ব-যার উদ্দেশ্যাবলির মধ্যে গণতন্ত্রের জন্য বিশ্বকে নিরাপদ করার ধারণা অন্তর্ভুক্ত-তার অন্তর্গত নিরর্থকতা বলে কনরাড যাকে শনাক্ত করেছেন তা যুক্তরাষ্ট্রের সরকার এখনও পর্যন্ত অনুধাবন করতে ব্যর্থ, যেহেতু তারা সারা দুনিয়ায়, বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যে, তাদের ইচ্ছা বাস্তবায়নে সচেষ্ট। কনরাডের অন্ততপক্ষে এটা দেখতে পাওয়ার সাহসটুকু ছিল যে, এরকম কোনো পরিকল্পনা কখনো সফলকাম হয় না। কেননা এগুলো পরিকল্পকদের বেশি করে অসীম ক্ষমতার বিভ্রম ও বিভ্রান্তিকর আত্মপ্রসাদের ফাঁদে ফেলে দেয়। (যেমনটি ঘটে ভিয়েতনামে), আর যেহেতু তাদের স্বীয় চারিত্র্যগুণে তারা প্রমাণকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করে। যদি নোস্ত্রমো-কে এর বিপুল শক্তি ও অন্তর্গত সীমাবদ্ধতার প্রতি কিছুটা মনোযোগ রেখে পাঠ করতে হয় তবে এ সবকিছু মাথায় রাখা উপযুক্ত কাজ হবে। উপন্যাসের শেষের দিকে সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত ক্ষুদ্র রাষ্ট্র সুলাকো আর কিছু নয়, যে বৃহত্তর রাষ্ট্র থেকে এর উৎপত্তি এবং যাকে সে ধন ও গুরত্বে প্রতিস্থাপিত করে, তারই কঠোরতরভাবে নিয়ন্ত্রিত এবং আরো অসহিষ্ণু ক্ষুদ্রতর একটি সংস্করণ। কনরাড পাঠককে এটা অনুধাবন করতে দিয়েছেন যে, সাম্রাজ্যবাদ হলো একটা পদ্ধতি। কোনো অধস্তন অভিজ্ঞতার এলাকায় জীবন চিত্রিত হয় আধিপত্যকারী এলাকার কল্পনা ও মূখতার দ্বারা। কিন্তু এর উল্টোটাও সত্যি ল্যা মিশিওঁ সিভিলিজাজিস (সভ্যকরণ মিশন)-এর প্রয়োজনে যেরকমটি দেখা যায়, যখন আধিপত্যকারী সমাজের অভিজ্ঞতা প্রশ্নাতীতভাবে নেটিভদের ও তাদের অঞ্চলগুলোর উপর নির্ভর করে। যেভাবেই পড়া হোক, নোস্ত্রমো এক ভীষণরকম ক্ষমাহীন মতামত উপস্থাপন করে, আর এটি এ্যায়েম গ্রীনের দ্য কোয়ায়েট আমেরিকান কিংবা ভি. এস. নইপলের আ বেন্ড ইন দ্য রিভার-এ পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের বিভ্রম সম্পর্কে আক্ষরিকভাবে একইরকম ঝাঝালো মতামত দানে প্রণোদিত করে, যদিও শেষোক্ত উপন্যাস দুটোর বিষয়সূচি একদম আলাদা। ভিয়েতনাম, ইরান, ফিলিপাইন, আলজিরিয়া, কিউবা, নিকারাগুয়া, ইরাকের পর আজকের দিনে খুব স্বল্পসংখ্যক পাঠক এতে অমত করবেন যে, গ্রীনের পাইল বা নইপলের ফাদার হুইজমাসের মতো মানুষ যাদের বিশ্বাস নেটিভদেরকে আমাদের সভ্যতায় শিক্ষিত করে তোলা সম্ভব, তাদের চরিত্রের উষ্ণ সারল্যই ঠিকঠাক আদিম সমাজগুলোয় হত্যা, দমন, এবং সীমাহীন অস্থিরতা উৎপাদন করে। একইরকম ক্রোধ ছড়িয়ে রয়েছে অলিভার স্টোনের সালভাদর, ফ্রান্সিস ফোর্ড কপোলার অ্যাপোক্যালিপস নাউ, এবং কনস্তান্তিন কস্তা-গাভরার মিসিং-এর মতো চলচ্চিত্রগুলোর পরতে পরতে যেখানে বিবেকবর্জিত সিআইএ গোয়েন্দা আর ক্ষমতাপাগল কর্মাধিকারিকেরা যুগপৎ নেটিভ আর সদিচ্ছাপরায়ণ মার্কিনীদের নিজেদের মতো করে ব্যবহার করে। 
এরপরও, নোস্ত্রমো-য় প্রকাশিত কনরাডের সাম্রাজ্যবাদবিরোধী শ্লেষের নিকট গভীরভাবে ঋণী এই সকল রচনা তর্ক তোলে যে, বিশ্বের তাৎপর্যপূর্ণ জীবন ও কর্মের গর্ভগৃহ হলো পাশ্চাত্য যার প্রতিভূগণ মৃতমনন তৃতীয় বিশ্বের উপর যখন ইচ্ছা তখন তাদের কল্পনা ও মানবহিতের স্বেচ্ছাচার চাপিয়ে দিতে পারে। এই মতানুসারে, বিশ্বের প্রান্তবর্তী অঞ্চলসমূহের বলার মতো কোনো জীবন, ইতিহাস, বা সংস্কৃতি নেই, পাশ্চাত্যের বাইরে কারো নেই বলবার মতো কোনো স্বাধীনতা অথবা সততা। আর যখন কোনো কিছুকে বর্ণনা করা হয়, তখন তা, কনরাড অনুসারে, অকথ্যভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত, ক্ষয়প্রাপ্ত, মেরামত-আযোগ্য। অথচ, কনরাড যেখানে নোস্ত্রমো লিখেছিলেন ইউরোপের প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন সাম্রাজ্যবাদী জোশের কালে, সেখানে সমসাময়িক লেখক ও চলচ্চিত্রকারবৃন্দ যারা তাঁর শ্লেষকে দারুণভাবে আয়ত্ত করে নিয়েছেন, তাঁরা কাজ করেছেন বি-উপনিবেশায়নের পরে, পাশ্চাত্য কর্তৃর্ক অপশ্চিমা জগতের উপস্থাপনায় ব্যাপক বুদ্ধিবৃত্তিক, নৈতিক, ও কল্পনাশ্রয়ী উলটপালট ও বিনির্মাণের পরে, ফ্রাঞ্জ ফানো, এমিলকার কাবরেল, সিএলআর জেমস, ওয়ল্টার রোডনির রচনাকর্ম প্রকাশিত হয়ে যাবার পরে, আর চিনুয়া আচেবে, নৃগুগি ওয়া থিয়ঙ্গো, ওলে সোয়িঙ্কা, সালমান রশদি, গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কে ও অন্য অনেকের নাটক ও উপন্যাস প্রকাশিত হবার পরে। 
 এভাবে কনরাড তাঁর সাম্রাজ্যবাদী প্রবণতার অবশেষটুকু রেখে যান, যদিও তার উত্তরসাধকেরা নিজেদের রচনার সূক্ষ্ম ও অননুধ্যায়ী পক্ষপাতের ন্যায্যতা প্রতিপাদনে কদাচিৎ কোনো অজুহাত খুঁজে পান। এটা শুধুমাত্র পশ্চিমাদের বিষয় নয়, যাদের বিদেশি সংস্কৃতির ব্যাপারে যথেষ্ট সহানুভূতি অথবা বোধ নেই-যেহেতু সবকিছুর পরও বাস্তবে এমন কিছু শিল্পী ও বুদ্ধিজীবী আছেন যারা সীমা অতিক্রম করেছেন-জঁ ঝেনে, বজিল ডেভিডসন, আলবার্ত মেমি, হুয়ান গয়তিসোলো প্রমুখ। বোধ করি, সাম্রাজ্যবাদের বিকল্প কিছুকে গুরুত্ব দেয়ার প্রতি রাজনৈতিক সদিচ্ছাটা এখন আরো প্রাসঙ্গিক যখন বিকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে অন্যান্য সংস্কৃতি ও সমাজের অস্তিত্ব। কনরাডের অসামান্য উপন্যাসটি লাতিন আমেরিকা, এশিয়া কিংবা আফ্রিকার প্রতি পশ্চিমাদের স্বভাবজাত সন্দেহবাদকে নিশ্চিত করে বলেই কেউ বিশ্বাস করুক বা নোস্ত্রমো অথবা গ্রেট এক্সপেক্টেশনস-এর মতো উপন্যাসে লেখক ও পাঠক উভয়ের প্রেক্ষণকে আচ্ছাদিত করতে সমর্থ আশ্চর্যজনকভাবে দীর্ঘজীবী সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বদর্শনের রূপরেখাই কেউ দেখতে পান, প্রকৃত বিকল্পের দু'রকমের পাঠই অচল বলে প্রতীয়মান হয়। বর্তমান বিশ্ব এমন কোনো প্রদর্শরূপে অস্তিত্বশীল নয় যাকে নিয়ে আমরা আশাবাদী বা নৈরাশ্যবাদী হতে পারি, বা যার সম্পর্কে আমাদের পাঠ্য হয় প্রতিভাদীপ্ত অথবা বিরক্তিকর হতে পারে। এরকম সকল মনোভাবের অন্তর্গত থাকে ক্ষমতা ও স্বার্থের যোগ। কনরাডকে যে-পরিমাণে স্বসময়ের সাম্রাজ্যবাদী আদর্শের যুগপৎ সমালোচনা এবং পুনর্বয়ান করতে দেখি, সেই পরিমাণেই আমরা নিজেদের বর্তমান মনোভাবের চরিত্রায়ন ঘটাতে পারি এভাবে: আধিপত্যবাদী ইচ্ছার প্রতিফলন বা প্রতিরোধ, নিন্দাবাদের সামর্থ্য, কিংবা অন্যান্য সমাজ, ঐতিহ্য, ইতিহাসকে বোঝা বা তাদের সঙ্গে জড়িত হবার শক্তি। 
কনরাড ডিকেন্সের পর দুনিয়া অনেক বদলেছে-নানাভাবে আর প্রায়শ, শঙ্কিত করে তুলেছে ইউরোপ ও আমেরিকাবাসীদের যারা এখন বিপুল সংখ্যক অশ্বেতাঙ্গ অভিবাসী সামলাচ্ছে আর মুখোমুখি হচ্ছে নবক্ষমতায়িত কণ্ঠের আখ্যান শোনানোর ধারাবাহিক মর্মস্পর্শী আহ্বানের। আমার গ্রন্থের মূল প্রসঙ্গ হলো আধুনিক সাম্রাজ্যবাদ প্রযোজিত বিশ্বায়িত প্রক্রিয়ার বদান্যতায় ওইরূপ জনতা আর কণ্ঠ সেখানে ইতিমধ্যে বেশ অনেকটা সময় ধরেই বর্তমান। পাশ্চাত্য ও প্রাচ্যবাসীদের পরস্পর-অধিক্রমী অভিজ্ঞতা যে সাংস্কৃতিক ভূমিতে উপনিবেশী আর উপনিবেশায়িত সহাবস্থান করেছে এবং অনুমান ও তৎসহ প্রতিদ্বন্দ্বী ভূগোল, আখ্যান ও ইতিহাস নিয়ে সংগ্রামলিপ্ত থেকেছে তাদের আন্তঃনির্ভরতাকে অবহেলা বা অন্যভাবে অবমূল্যায়ন করার অর্থ বিগত শতকের বিশ্বে যা অপরিহার্য ছিল তাকে এড়িয়ে যাওয়া। এই প্রথমবারের মতো এখন সাম্রাজ্যবাদের ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে এমনভাবে পাঠ করা সম্ভব যেন এরা অবিভক্ত ও সমসত্ব নয়, আবার ক্ষুদ্রতর উপখণ্ডসমূহের সমষ্টি, ভিন্ন কিংবা পরস্পরবিচ্ছিন্নও নয়। সত্য যে ভারতে হোক, লেবাননে বা যুগোশ্লাভিয়ায় কিংবা আফ্রিকাকেন্দ্রিক হোক, ইসলামকেন্দ্রিক বা ইউরোপকেন্দ্রিক ঘোষণাসমূহে বিচ্ছিন্নতাবাদী ও উগ্রজাতীয়তাবাদী ডিসকোর্সের বিরক্তিকর বিস্ফোরণ ঘটেছে; সাম্রাজ্য থেকে মুক্তির সংগ্রামকে মূল্যহীন করে তোলার তুলনায় বহুদূরে গিয়ে সাংস্কৃতিক ডিসকোর্সের এই ক্ষুদ্রায়ন এক মৌলিক মুক্তিকামী শক্তির সারবত্তা প্রমাণ করে যা স্বাধীন হবার, অন্যায় আধিপত্যভারমুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে কথা বলার আকাঙ্ক্ষাকে উদ্দীপ্ত করে। যা হোক, এই শক্তিকে বোঝবার একমাত্র উপায় ঐতিহাসিক প্রেক্ষণ দিয়ে তা করা: আর সে-কারণেই এই গ্রন্থে বরং ভৌগোলিক ও ঐতিহাসিক বেধের বিপুল বিস্তার। আমাদের নিজেদের স্বরকে শ্রবণযোগ্য করে তোলার বাসনায় আমরা ভুলে যাই পৃথিবীটা একটা ভিড়ের জায়গা, এটাও যে যদি প্রত্যেকে নিজের স্বরের মৌলিকত্ব ও প্রাধান্যের উপর জোর দিতে থাকত তবে আমাদের প্রাপ্তি হতো অনিঃশেষ যন্ত্রণার এক অস্বাভাবিক কোলাহল আর এক রক্তাক্ত রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা যার প্রকৃত ভীতিপ্রদ চেহারা দেখা দিতে শুরু করেছে ইউরোপের এখানে সেখানে বর্ণবাদী রাজনীতির পুনরাবির্ভাবে, আমেরিকায় রাজনৈতিক শুদ্ধতা ও পরিচয়কেন্দ্রিক রাজনীতির বিসম্বাদে, এবং আমার নিজের এলাকার কথা বলতে গেলে, ধর্মীয় অন্ধবিশ্বাসের অসহিষ্ণুতায় এবং সাদ্দাম হোসেন ও তাঁর বহু অনুকারী প্রতিদ্বন্দ্বীদের মাধ্যমে ঘটা বিসমার্কীয় স্বৈরতন্ত্রের অলীক প্রতিশ্রতিতে। 
 সুতরাং, কী গুরুগম্ভীর ও উৎসাহব্যঞ্জক বিষয় এটা যেন শুধু নিজের পক্ষকেই পাঠ করা নয়, বরং এটাও অনুধাবন করা যে, কিপলিংয়ের মতো একজন মহৎ শিল্পী কী নিপুণ দক্ষতায় ভারতকে উপস্থাপন করেছেন, আর তা করতে গিয়ে কীভাবে তার উপন্যাস কিম শুধু যে ইঙ্গ-ভারতীয় প্রেক্ষিতের লম্বা ইতিহাসের উপর নির্ভর করেছে তাই নয়, নিজের অস্তিত্ব সত্ত্বেও এর মধ্যে যে বিশ্বাসের ওপর জোর দেয়া হয়েছে, অর্থাৎ, ভারতীয় বাস্তবতার প্রয়োজন ছিল এবং কম বেশি অনির্দিষ্টভাবে তা ব্রিটিশ অভিভাবকত্বের জন্য মিনতি করেছে-এর অগ্রহণযোগ্যতার পূর্বাভাষ দিয়েছে। সাগরপারের যে সমস্ত অধিকৃত এলাকায় বুদ্ধিবৃত্তিক ও নান্দনিক বিনিয়োগ ঘটেছে, আমার মতে, সে-সব জায়গায় রয়েছে বিরাট বিরাট সাংস্কৃতিক মহাফেজখানা। আপনি যদি ১৮৬০-এর দিকের ব্রিটিশ বা ফরাসি নাগরিক হতেন, তবে আপনি ভারত কিংবা উত্তর আফ্রিকাকে পরিচিত ও অপরিচিতের যুগলবন্দি হিসেবে দেখতেন ও অনুভব করতেন, কিন্তু তাদের আলাদা সার্বভৌমত্বের নিরিখে কখনোই তা করতেন না। আপনার আখ্যান, ইতিহাস, ভ্রমণকাহিনি ও অভিযানসমূহে আপনার চেতনা প্রধান কর্তৃত্বকারী হিসেবে, যা উপনিবেশবাদী কর্মকাণ্ডের শুধু নয়, বরং বিদেশি ভূগোল ও জনতাকে যৌক্তিক করে তোলে এমন শক্তির এক প্রচল বিন্দু হিসেবে প্রতিভাত হতো। সর্বোপরি, আপনার ক্ষমতার চেতনা ঘুণাক্ষরে ভাবতে পারত না যে ওইসব নেটিভ লোকেরা যারা সর্বদা অনুগত ছিল অথবা ছিল অগোচরে অসহযোগিতাপ্রবণ, তারা কখনো ভারত বা আলজিরিয়া ত্যাগ করতে আপনাকে বাধ্য করবে; অথবা এমন কিছু বলতে সক্ষম হবে যা হয়তো বলবৎ ডিসকোর্স-এর বিরুদ্ধতা, প্রতিরোধ, কিংবা অন্য অর্থে, প্রতিস্থাপন করবে। সাম্রাজ্যবাদের সংস্কৃতি অদৃশ্য ছিল না, না এটা এর ঐহিক আসন ও স্বার্থ লুকানোর চেষ্টা করেছে। সংস্কৃতির প্রধান চরণগুলোর মধ্যে নথিভুক্ত হয়েছে প্রায়শ সতর্ক অঙ্কপাতন এবং এদিকে যে খুব একটা মনোযোগ দেয়া হয়নি তা লক্ষ করার পক্ষে যথেষ্ট স্বচ্ছতা রয়েছে। সেগুলো এই গ্রন্থের এবং এর মতো অন্যান্য গ্রন্থকে উস্কে দেয়ার মতো বিষয়ে আগ্রহদ্যোতক কেন এই প্রশ্ন এক ধরনের ভূতাপেক্ষ প্রতিশোধস্পৃহা থেকে যতটা না তার থেকে বেশি করে উদ্ভূত হয়েছে যোগাযোগ এর প্রয়োজনীয়তা থেকে। সাম্রাজ্যবাদের অন্যতম অর্জন ছিল বিশ্বকে ছোট করে আনা। আর যদিও এই প্রক্রিয়ায় ইউরোপীয় ও নেটিভদের মধ্যে বিচ্ছিন্নায়ন ছিল ছলনাপূর্ণ ও মূলগতভাবে অন্যায়, আমাদের বেশিরভাগই এখন সাম্রাজ্যের ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতাকে সাধারণ বলেই ধরে নেয়। আতঙ্ক, রক্তপাত, আর প্রতিহিংস তিক্ততা সত্ত্বেও ভারতীয় ও ব্রিটিশদের, আলজিরিয় ও ফরাসিদের, পশ্চিমা ও আফ্রিকীয়, এশীয়, লাতিন আমেরিকান, এবং অস্ট্রেলিয়দের সঙ্গে সম্পর্কযুক্তরূপে একে বর্ণনা করাই হলো আসল কাজ। আমার পদ্ধতি হলো স্বতন্ত্র কর্মের দিকে যতটা সম্ভব নজর দেয়া এবং সেগুলোকে। প্রথমত সৃষ্টিশীল অথবা ব্যাখ্যামূলক কল্পনার মহৎ সৃজন হিসেবে পাঠ করা। আর তারপর সংস্কৃতি ও সাম্রাজ্যবাদের মধ্যকার সম্পর্কের অংশ হিসেবে তাদেরকে দেখানো।

No comments:

Post a Comment