Introduction to Culture and Imperialism - Edward Said – Translation in Bengali (Part 1 of 3) |
Introduction
to Culture and
Imperialism - Edward Said – Translation in Bengali (Part 1 of 3)
১৯৭৮ সালে
ওরিয়েন্টালিজম প্রকাশিত হবার বছর পাঁচেক পর বইটি রচনাকালে সংস্কৃতি ও সাম্রাজ্যের
মধ্যেকার সাধারণ সম্বন্ধের যে ব্যাপারটি আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল, সে বিষয়ে
আমি কিছু ধারণা জড়ো করতে শুরু করি। এ চেষ্টার প্রাথমিক ফল হলো ১৯৮৫ ও ১৯৮৬ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও ইংল্যান্ডের
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে দেয়া আমার বক্তৃতাগুলো। আমাকে সেই সময় থেকে ব্যস্ত রাখা।
আমার বর্তমান
কাজের কেন্দ্রীয় যুক্তি সংগঠিত করেছে এই বক্তৃতামালা। মধ্যপ্রাচ্যকে নিয়ে সীমাবদ্ধ ওরিয়েন্টালিজম-এ যে-সব যুক্তি আমি পেশ করেছি
তা নৃবিজ্ঞান, ইতিহাস এবং অঞ্চলবিদ্যা বিষয়ে আমার সবিশেষ জানাশোনা থেকে উদ্ভূত হয়েছে।
সুতরাং আমি এখানে আধুনিক নগরায়িত প্রতীচ্য ও এর সাগরপারের অধিকৃত অঞ্চলগুলোর মধ্যকার
সম্বন্ধের সাধারণ বিন্যাস বর্ণনার উদ্দেশ্যে পূর্বতন গ্রন্থের যুক্তিগুলোকে বিস্তারিত
করতে সচেষ্ট হয়েছি।
তো এখানে
আলোচিত অ-মধ্যপ্রাচ্যীয় সামগ্রীগুলোর কয়েকটা কী কী? আফ্রিকা, ভারত, দূরপ্রাচ্যের
অংশ বিশেষ, অস্ট্রেলিয়া এবং ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জ-এদের সম্পর্কে ইউরোপের লেখাজোখা,
এই সব আফ্রিকাতাত্ত্বিক ও ভারততাত্ত্বিক প্রকরণ এদের কোনো কোনোটাকে যা বলে ডাকা হয়
এদের আমি দেখি দূরবর্তী অঞ্চল ও তার অধিবাসীদের শাসন করার
সাধারণ ইউরোপীয় প্রয়াসের অংশ হিসেবে এবং ফলত, ইসলামি বিশ্বের প্রাচ্যবাদী বর্ণনার
সাথে এবং একই সঙ্গে ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জ, আয়ারল্যান্ড ও দূর প্রাচ্যকে বর্ণনার বিশেষ
ইউরোপীয় কৌশলের সাথে সম্পর্কিত হিসেবে। এই সব তত্ত্ববিলাসের মধ্যে আগ্রহোদ্দীপক বিষয়
যেটি তা হলো বারবার নানা বাচ্যালঙ্কারের মুখোমুখি হতে হয়। এগুলোতে পাওয়া ‘রহস্যময় প্রাচ্য’-এর বর্ণনা আর ‘আফ্রিকীয় [ অথবা ভারতীয়,
কিংবা আইরিশ বা জ্যামাইকান কি চৈনিক ] মানস’ সম্পর্কিত ছকবাঁধা
বয়ানে, আদিম বা অসভ্য জনপদে সভ্যতা পৌঁছে দেয়ার ভণিতায়, চাবকে মেরে ফেলা বা প্রলম্বিত
শাস্তির বিরক্তিকরভাবে পরিচিত ধারণায় যার দরকার হতো ‘তারা অসদাচারণ করলে,
কারণ তারা প্রসঙ্গত শক্তি বা সহিংসতার ভাষা সবচেয়ে ভালো বুঝত; ‘আমরা যেমন ‘তারা’ সেরকম ছিল না, আর সে-কারণে
শাসিত হতে বাধ্য ছিল।
এরপরও বাস্তবে
প্রায় সকল অ-ইউরোপীয় অঞ্চলে সাদা মানুষদের আগমন কোনো না কোনো ধরনের বাধার সম্মুখীন
হয়েছে। পাশ্চাত্য প্রাধান্যের বিরদ্ধে এই প্রতিক্রিয়া, যার উত্তুঙ্গ
অবস্থায় তৃতীয় বিশ্বের সর্বত্র উপনিবেশবিলোপের মহা আন্দোলন শুরু হয়। বিষয়টিকে আমি ওরিয়েন্টালিজম-এর আওতার বাইরে রেখেছিলাম। উনিশ শতকীয়
আলজিরিয়া, আইসল্যান্ড এবং ইন্দোনেশিয়ার মতো বিচিত্র জায়গায় সংগঠিত হওয়া সশস্ত্র
প্রতিরোধের পাশাপাশি প্রায় সর্বত্র সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ, জাতীয় পরিচয়ের ঘোষণা, আর
রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে স্বাধিকার ও জাতীয় স্বাধীনতা অর্জনের সাধারণ লক্ষ্যে সংগঠন বা
দল গড়ে তোলার উল্লেখযোগ্য প্রয়াস চলছিল। এক্ষেত্রে কখনোই এমন ঘটেনি যে সাম্রাজ্যের
সংঘাতে উদ্যমী অনুপ্রবেশকারীরা নিরীহ বা নিষ্কর্মা অ-পশ্চিমা দেশি লোকদের উপর চড়ে
বসেছে! সর্বদা কোনো না কোনো ধরনের সক্রিয় প্রতিরোধ সচল ছিল, এবং অবিশ্বাস্য রকম সংখ্যাগরিষ্ঠ
ক্ষেত্রে এই প্রতিরোধ শেষ পর্যন্ত জয়ী হয়েছে।
সাম্রাজ্যবাদী
সংস্কৃতির বিশ্বব্যাপী সাধারণ বিন্যাস আর সাম্রাজ্য-বিরোধী প্রতিরোধ সংগঠনের ঐতিহাসিক
অভিজ্ঞান-এই দুই নিয়ামক বর্তমান গ্রন্থকে এমন বিচিত্রভাবে সংস্পষ্ট করেছে যে এটা ওরিয়েন্টালিজম-এর
উত্তরবয়ানমাত্র হয়ে থাকেনি বরং ভিন্নতর কিছু করার একটা চেষ্টায় পরিণত হয়েছে। দুই গ্রন্থেই আমি গুরত্বারোপ করেছি সাধারণভাবে যাকে
আমি ‘সংস্কৃতি’ বলে অভিহিত করি তার
উপর। আমার ব্যবহার্য ‘সংস্কৃতি’ শব্দটি বিশেষত দুটো
জিনিসকে বোঝায়। প্রথমত, বর্ণনা, যোগাযোগ ও উপস্থাপনার কলাকৃতির ন্যায় সেই সকল চর্চাকে
বোঝায় যেগুলো অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক অঞ্চল থেকে তুলনামূলকভাবে স্বাধীন এবং
প্রায়শ আকৃত হয় নান্দনিকরূপে যার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য বিনোদন। অবশ্যি এর সাথে
যুক্ত বিশ্বের দূরবর্তী অংশসমূহ সম্পর্কে জনপ্রিয় লোককাহিনির ভাণ্ডার আর জাতিবিদ্যা,
ইতিহাসবিদ্যা, ভাষাবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, এবং সাহিত্যিক ইতিহাস প্রভৃতি জ্ঞানগর্ভ বিষয়
থেকে প্রাপ্ত বিশেষায়িত জ্ঞান-এদের উভয়ই। যেহেতু উনিশ ও বিশশতকের আধুনিক পাশ্চাত্য
সাম্রাজ্যসমূহ আমার আলোচনার মূল লক্ষ্যবস্তু, সেহেতু আমি বিশেষ করে উপন্যাসের মতো সাংস্কৃতিক
সংগঠনগুলোকে লক্ষ করেছি। সেগুলো, আমার মতে, সাম্রাজ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গি, সূত্র, ও অভিজ্ঞতানির্মাণে
অতিশয় গুরত্বপূর্ণ ছিল। আমি বলতে চাচ্ছি না যে শুধুমাত্র উপন্যাসই গুরত্বপূর্ণ ছিল,
বরং এটা ছিল সেই নান্দনিক বস্তু যার সঙ্গে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের বর্ধিষ্ণু সমাজগুলোর
যোগসূত্র, আমার বিশ্বাস, অধ্যয়নের পক্ষে দারুণ
আগ্রহোদ্দীপক।
আধুনিক
বাস্তববাদী উপন্যাসের আদিরূপ হলো রবিনসন ক্রুসো আর অবশ্যই এটা দুর্ঘটনাক্রমে ঘটেনি যে, এই উপন্যাস একজন ইউরোপীয় ব্যক্তি সম্বন্ধে
যে দূরবর্তী এক অ-ইউরোপীয় দ্বীপে নিজের জন্য এক জায়গীর স্থাপন করেছে।
সাম্প্রতিক
সময়ের বিপুল পরিমাণ সমালোচনাকর্মে আখ্যানমূলক কথাসাহিত্যে অনুধ্যান দেয়া হয়েছে,
তবে ইতিহাস ও সাম্রাজ্যের জগতে এর অবস্থান সম্পর্কে খুব সামান্য অভিনিবেশ প্রযুক্ত
হয়েছে। এই গ্রন্থের পাঠকেরা খুব তাড়াতাড়ি জেনে যাবেন যে, এস্থানে আমার যুক্তিতর্কের
জন্য আখ্যান খুব জরুরী, যেহেতু আমার মূল বক্তব্য
হচ্ছে, অভিযাত্রী ও ঔপন্যাসিকেরা বিশ্বের অগমপূর্ব অঞ্চলসমূহের ব্যাপারে যা কিছু বলেন
তার অন্তরে রয়েছে গল্পকাহিনি। এগুলো উপনিবেশস্থ লোকদের আত্মপরিচয় ও নিজস্ব ইতিহাসের
অস্তিত্ব বিঘোষণের কৌশলও হয়ে উঠেছে। সাম্রাজ্যবাদের প্রকৃত যুদ্ধ অবশ্যই ভূমি নিয়ে।
কিন্তু এই ভূমির মালিক কে, এতে বসতি স্থাপন ও কাজকর্মের অধিকারী কে, কে একে চালিয়ে
নিচ্ছে, কে এটা পুনরায় অধিকার করেছে, এবং কে এর ভবিষ্যৎ নিয়ে পরিকল্পনা আঁটছে-এসব
প্রশ্ন যখন উঠত তখন এগুলো সৃজিত, আলোচিত ও কখনো-বা নির্ধারিত হতো আখ্যানের মধ্যে। যেমনটি
কোনো এক সমালোচক বলেছেন, জাতিসমূহ নিজেরাই আখ্যানকর্ম। আখ্যান রচনার কিংবা অন্যবিধ
আখ্যানসমূহের সংগঠন ও আবির্ভাব রহিত করার ক্ষমতা সংস্কৃতি ও সাম্রাজ্যবাদের কাছে খুব
গুরত্ব পায় আর উভয়ের মধ্যে অন্যতম প্রধান সংযোগসূত্র রচনা করে। আরো গুরত্বপূর্ণ হলো,
মুক্তি ও আলোকায়নের মহা-আখ্যান উপনিবেশের বিশ্বে জনতাকে জাগ্রত হয়ে সাম্রাজ্যের বশ্যতাকে
ছুঁড়ে ফেলতে উদ্বুদ্ধ করেছে। এই প্রক্রিয়ায় অনেক ইউরোপীয় ও আমেরিকান এসব কাহিনি
ও এদের নায়কদের দ্বারা আন্দোলিত হয়েছেন এবং তারাও সাম্য ও মানব সম্প্রদায়ের নতুন
নতুন আখ্যান রচনার সংগ্রামে ব্রতী হয়েছেন।
দ্বিতীয়ত,
প্রায় অগোচরভাবে, সংস্কৃতি হলো শোধনকারী ও উৎকর্ষসাধক উপাদানসমন্বিত এক ধারণা, যেরকমটি
১৮৬০'র দিকে ম্যাথু আর্নল্ড লিখেছিলেন যে এটা হলো শ্রেয়তম
জ্ঞান ও চিন্তার জন্য সমাজের রক্ষণাগার। আর্নল্ড বিশ্বাস করতেন যে, আধুনিক, উগ্র, বাণিজ্যমুখী,
ও নির্মম নাগরিক অস্তিত্বকে পুরোপুরি প্রতিনিবৃত্ত না করতে পারলেও সংস্কৃতি একে লাঘব
করে। আপনি দান্তে কিংবা শেক্সপিয়র পড়েন জ্ঞান ও চিন্তার রাজ্যে যা কিছু সেরা তাদের
সাথে তাল মিলিয়ে চলার উদ্দেশ্যে আর নিজেকে, জনতাকে, সমাজ ও সংস্কৃতিকে সেরা আলোয়
পরিবীক্ষণের জন্যও। কালক্রমে প্রায়ই সহিংসভাবে রাষ্ট্র বা জাতির সাথে সংযুক্ত হয়
সংস্কৃতি। এই ঘটনা প্রায় সবসময়ই কিছু মাত্রায় বিদেশভীতিসহ ‘আমরা’ ও ‘তারা'-এ দুয়ের মধ্যে
পার্থক্য রচনা করে। এই অর্থে সংস্কৃতি পরিচয়ের একটি উৎস, এক সংগ্রামশীল উৎস যেমন ইদানীং
সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যে ‘প্রত্যাবর্তন’-এ লক্ষণীয়। এইসব প্রত্যাবর্তন
সঙ্গী হয় কঠোর বৃদ্ধিবৃত্তিক এবং নৈতিক আচরণবিধিমালার যেগুলো বহুসংস্কৃতিবাদ ও সংকরায়নবাদের
মতো তুলনামূলকভাবে উদার দর্শনসমূহের সঙ্গে যুক্ত প্রশ্রয়প্রবণতার বিরোধী। সাবেক ঔপনিবেশিক
বিশ্বে এইসব প্রত্যাবর্তন’ নানারকম ধর্মীয় ও জাতীয়তাবাদী মৌলবাদের জন্ম
দিয়েছে।
এই দ্বিতীয়
অর্থে, সংস্কৃতি এক প্রকার মঞ্চ, যেখানে নানাবিধ রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত ব্যাপার-স্যাপার
পরস্পরকে ব্যস্ত রাখে। সংস্কৃতি হতে পারে অ্যাপোলনীয় ভদ্রলোকদের
শান্তসমাহিত জগৎ থেকে সুদূরবর্তী এমন একটি রণক্ষেত্র যেখানে কারণসমূহ দিবালোকে নিজেদেরকে
প্রকাশিত করে এবং পরস্পর দ্বন্দ্বে প্রবৃত্ত হয়, এটা প্রমাণ করতে যে, উদাহরণস্বরূপ,
মার্কিন, ফরাসি, বা ভারতীয় ছাত্রদেরকে অন্যকিছু পাঠ করবার পূর্বে তাদের নিজেদের জাতীয়
ক্লাসিকগুলো পড়তে শেখানো হয় এই আশায় যে তারা, প্রায়শ নির্বিচারে, অন্যান্যদের অবমূল্যায়ন
বা প্রতিরোধ করতে করতে, সেগুলোর (নিজ সংস্কৃতির) উচ্চমূল্য দেবে এবং সেগুলোর প্রতি বিশ্বস্ত থাকবে।
এখন সংস্কৃতির
এই ধারণা নিয়ে সমস্যা হলো, এটা নিজ সংস্কৃতির গৌরবায়নকেই শুধু নয় বরং উৎসাহিত করে
এরকম ভাবতে যে, ওটা প্রাতিস্বিক জগৎকে অতিক্রম করে যাবার কারণে এর থেকে কোনোভাবে বিযুক্ত।
ফলে, একদিকে দাসপ্রথা, উপনিবেশী ও বর্ণবাদী নির্যাতন এবং সাম্রাজ্যবাদী অবদমনের মতো
চর্চাসমূহের প্রলম্বিত ও কর্কশ নিষ্ঠুরতা, আর অন্যদিকে এইসব চর্চায় প্রবৃত্ত কাব্যকলা,
কথাশিল্প, সমাজদর্শনের মধ্যে যোগসূত্র অনুধাবনে বেশিরভাগ পেশাদার মানবতাবাদী ব্যর্থ
হন। এই গ্রন্থের কাজ করতে গিয়ে কঠিন যে সব সত্যের মুখোমুখি
হয়েছি, সেগুলোর একটি হলো কর্মকর্তাদের মধ্যে সুপরিচিত এবং ভারত বা আলজেরিয়া শাসনকালে
বহুচর্চিত ‘প্রজা’ বা ‘অধস্তন’ এর ধারণা সম্পর্কে
আমার পছন্দের ব্রিটিশ ও ফরাসি শিল্পীদের মাত্র ক’জনই মাথা ঘামিয়েছেন। এগুলো বিপুলভাবে গৃহীত ধারণা ছিল এবং উনিশ
শতকজুড়ে আফ্রিকায় সাম্রাজ্যবাদী সম্প্রসারণে ইন্ধন যুগিয়েছে। কার্লাইল বা রাস্কিন
অথবা ডিকেন্স বা থ্যাকারেকে নিয়ে ভাবনাচিন্তা করার সময়ে আমার মনে হয় সমালোচকেরা
প্রায়ই ঔপনিবেশিক সম্প্রসারণ, অধস্তন জাতিসমূহ, বা ‘নিগার’দের বিষয়ে এই লেখকদের
ধারণাকে সংস্কৃতি অপেক্ষা ভিন্ন বিভাগে পর্যায়ভুক্ত করেন, অথচ সংস্কৃতি হলো সেই উৎকর্ষপ্রাপ্ত
কর্মক্ষেত্র যাতে তারা সত্যিসত্যি’ অংশ নেন আর তাঁদের
প্রকৃত গুরত্ববাহী কাজগুলো সম্পাদন করেন।
এই প্রক্রিয়ায়
আচরিত সংস্কৃতি একটি ঘেরাটোপ হয়ে উঠতে পারে : প্রবেশের পূর্বে আপনার রাজনীতিকে একবার
যাচাই করে নিন। সারাজীবন সাহিত্যের শিক্ষকতা করা ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধপূর্ব ঔপনিবেশিক
জগতে বেড়ে ওঠা একজন হিসেবে সংস্কৃতিকে এভাবে-অর্থাৎ, বৈশ্বিক অনুমোদনের থেকে অসংক্রামক
দূরত্বে আবদ্ধ হিসেবে-না দেখে অসাধারণ বৈচিত্র্যবহুল ক্রিয়াক্ষেত্ররূপে দেখাটা আমার
কাছে দুরূহ মনে হয়েছে। এখানে বিবেচিত উপন্যাসগুলোর বিশ্লেষণ আমি করেছি, কেননা প্রথমত
আমার কাছে। এগুলো মূল্যায়নযোগ্য এবং শিল্প ও শিক্ষার প্রশংসাযোগ্য কর্ম, যেগুলোতে
আমি ও অন্যান্য অনেকে আমোদিত ও উপকৃত হই। দ্বিতীয়ত, চ্যালেঞ্জটা হলো শুধু সেই আনন্দ
ও উপকারিতার সঙ্গেই নয় বরং এদেরকে যুক্ত করা সেই সাম্রাজ্যবাদী প্রক্রিয়ার সঙ্গেও
যার স্বপ্রকাশ এবং অগোপন একটি অংশ ছিল এরা। নিজ সমাজের প্রশ্নাতীত যে বাস্তবতা, তাতে
এগুলোর অংশগ্রহণকে অভিযুক্ত বা অবজ্ঞা করার বদলে বরং আমার সুপারিশ হচ্ছে, এখন
অবধি অবহেলিত এই বিষয় সম্পর্কে যা কিছু আমরা শিখি তা এদের সম্পর্কে আমাদের পঠন ও বোধগম্যতা
সত্যিই বাড়িয়ে দেয়।
সুপরিচিত
ও মহৎ দুটি উপন্যাসকে ব্যবহার করে এই ফাঁকে বলে নিই আমার মনে কী রয়েছে। ডিকেন্স এর
গ্রেট এক্সপেক্টেশন্স (১৮৬১) প্রথমত আত্মপ্রবঞ্চনা সম্পর্কিত একটি উপন্যাস। প্রয়োজনীয়
কঠোর পরিশ্রম কিংবা আয়ের অভিজাত উৎস ছাড়াই পিপের ভদ্রলোক হয়ে ওঠার ব্যর্থ প্রয়াস
নিয়ে এ উপন্যাস। প্রথম জীবনে সে সাহায্য করেছিল দাগি আসামি অ্যাবেল ম্যাগউইচকে যে
অস্ট্রেলিয়াতে দ্বীপান্তরিত হবার পর তার তরুণ উপকারীকে বিপুল অর্থ
দিয়ে প্রতিদান দেয়। টাকা দেবার সময় দায়িত্বপ্রাপ্ত উকিল কিছু না বলায় পিপ নিজ থেকে ধরে নেয় যে, প্রৌঢ়া মিস হ্যাভিশামই
তার পৃষ্ঠপোষক। এরপর ম্যাগউইচ অবৈধভাবে আবার লন্ডনে দেখা দেয়-পিপ তাকে স্বাগত জানায়
না কারণ তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবকিছুর মধ্যে কুকর্ম আর অপ্রীতির গন্ধ ছড়ায়। অবশেষে
অবশ্যি ম্যাগউইচ ও তার বাস্তবতাকে মেনে নেয় পিপ: শেষ পর্যন্ত সে ধাওয়া খাওয়া, ধৃত
ও মারাত্মক অসুস্থ ম্যাগউইচকে তার পালক পিতা বলে স্বীকার করে নেয়। স্বীকার করে এমন
একজন হিসেবে যাকে প্রত্যাখ্যান বা নিরাশ করা যায় না, যদিও ম্যাগউইচ আদতে ইংল্যান্ডের
দ্বীপান্তরিত অপরাধীদের ফিরিয়ে না নিয়ে পুনর্বাসনের জন্য নির্মিত উপনিবেশ অস্ট্রেলিয়া
থেকে আসার দরুন অগ্রহণযোগ্য ছিল।
সব কটা
না হলেও এই উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্মের বেশিরভাগ পঠনই ব্রিটিশ কথাসাহিত্যের নাগরিক ইতিহাসের
সঙ্গে মানানসই করে একে স্থাপন করে কিন্তু আমার নিজের অভিমত হলো আরো ব্যাপক এবং গতিশীল
কোনো ইতিহাসে রয়েছে এর স্থান। রবার্ট হিউজের রাজকীয় গ্রন্থ দ্য ফ্যাটাল শোর এবং পল
কার্টার এর উজ্জ্বল কল্পনাশ্রয়ী দ্য রোড টু বোটানি বে - ডিকেন্সের
তুলনায় অনেকখানি সাম্প্রতিক এ দুটি বইয়ে প্রকাশ পেয়েছে অস্ট্রেলিয়া সম্পর্কে কল্পনা
ও এর অভিজ্ঞতার এক বিপুল বিস্তারী ইতিহাস। অস্ট্রেলিয়া-আয়ারল্যাণ্ডের মতো এক ‘সাদা উপনিবেশ যেখানে
আমরা ম্যাগউইচ ও ডিকেন্সকে চিহ্নিত করতে পারি শুধুমাত্র ওই ইতিহাসে কাকতালীয় সংযুক্তি
হিসেবে নয় বরং অংশী হিসেবে উপন্যাসের আখ্যানে এবং আরো বৃহৎ পরিসরে ইংল্যান্ড ও এর
সাগরপারের অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোর মধ্যে এবং পুরাতন অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে।
অষ্টাদশ
শতকের শেষপাদে একটা শাস্তিমূলক উপনিবেশ হিসেবে অস্ট্রেলিয়ার প্রতিষ্ঠা হয়, যাতে ইংল্যান্ড
তার দুর্দমনীয় দুষ্কৃতকারী অতিরিক্ত জনসংখ্যাকে আসলে ক্যাপ্টেন কুকের চার্ট করা একটা
জায়গায় পাঠিয়ে দিতে পারে যে জায়গা আবার কাজ করবে উপনিবেশ হিসেবে আমেরিকায় যেগুলো
ছেড়ে আসতে হয়েছে তাদের পরিবর্তরূপে।
এই লাভের পশ্চাদ্ধাবন, সাম্রাজ্যের বিস্তার এবং যাকে
হিউজ বলেছেন সামাজিক বর্ণদ্বেষ-এসব মিলে জন্ম দিয়েছে আধুনিক অস্ট্রেলিয়ার, যেটি এর
প্রতি ১৮৪০ সালের দিকে ডিকেন্সের প্রথম আগ্রহ জন্মানোর
সময়েই (ডেভিড কপারফিল্ড-এ উইলকিন্স ম্যাকেবার খুশিমনে সেখানে হিজরত করেন) বেশ অগ্রসর
হয়েছিল মুনাফায় এবং এককথায় ‘মুক্ত ব্যবস্থা’রূপে যেখানে শ্রমিকরা
সুযোগ পেলে নিজ চেষ্টায় উন্নতি লাভ করতে পারত। তবু ম্যাগউইচের দ্বীপান্তরের পর ডিকেন্স
অস্ট্রেলিয়াস্থ ইংরেজ দাগি আসামিদের সম্পর্কে ইংরেজদের ধারণায় কতকগুলো গিঁট পাকিয়ে
দিয়েছেন। তারা সফল হলেও হতে পারত, কিন্তু প্রকৃত অর্থে কদাচিৎ ফিরে আসতে পারত। একটা
কৌশলগত, আইনি ধারণায় তারা হয়তো তাদের অপরাধের ক্ষালন ঘটাতে সক্ষম হতো। কিন্তু তারা
চিরকালের বহিরিস্থিত হয়ে যাবার অনুভূতিতে ভুগত সেখানে। এরপরও দায়মুক্তির সক্ষমতা
ছিল তাদের যতক্ষণ তারা অস্ট্রেলিয়াতে থাকত। যাকে ডিকেন্স বলেছেন
অস্ট্রেলিয়ার ‘স্থানিক’ ইতিহাস, তাতে তার অবগাহন
ওই একই অভিজ্ঞতার আরেকটি ধরনের সাথে আমাদের পরিচিত করায়। এখানে অভিযাত্রী, অভিযুক্ত,
জাতিতত্ত্ববিদ, মুনাফা সন্ধানী, সৈনিক (নিজ নিজ প্রকল্পে রত হয়ে) এই সুবিশাল ও তুলনামূলকভাবে
ফাঁকা মহাদেশে পদার্পণ করেন যে ঘটনা অন্যদের প্রকল্পে ঘোঁট পাকায়, স্থানচ্যুত করে,
কিংবা তাকে অধিগ্রহণ করে। অতএব বোটানি-বে হলো প্রথমত ভ্রমণ ও আবিষ্কারভিত্তিক আলোকায়ন
প্রকল্প, তারপর একদল পরিব্রাজক কথক। (কুকসহ) যাদের শব্দমালা, পথনির্দেশ, এবং উদ্দেশ্য
অপরিচিত সমুদয় অঞ্চলকে অধিকার করে এবং ক্রমান্বয়ে তাকে ‘গৃহে পরিণত করে। স্থানের
বেন্থামীয় সংগঠন (যার থেকে মেলবোর্ন নগরীর উৎপত্তি ) এবং অস্ট্রেলীয় ঝোপঝাড়ের আপাত
বিশৃঙ্খলার মধ্যে কাটারের গ্রন্থে সন্নিকটত্ব প্রদর্শিত হয়েছে সামাজিক স্থানের এক
আশাবাদী রূপান্তর হিসেবে, যা ১৯৪০ এর দশকে ছিল ভদ্রলোকদের জন্য এক দিব্যধাম, শ্রমিকদের
জন্য নন্দনকানন। ম্যাগউইচের ‘লন্ডনী ভদ্রলোক' রূপে পিপ সম্পর্কে ডিকেন্স
যে-ভাবনা ভেবেছেন তা অস্ট্রেলিয়ার জন্য ইংরেজ হিতবাদী ভাবনার একধরনের পরিপূরক-একটি
সামাজিক স্থান অপরটির নির্মাণ করেছে।
তবে কার্টার
বা হিউজে যেমন আছে, গ্রেট এক্সপেক্টেশন্স কিন্তু তেমনভাবে অস্ট্রেলীয় দৈশিক বিবরণ
ইত্যাদি মাথায় রেখে লেখা হয়নি। আবার এটা অস্ট্রেলীয় লেখালেখির ঐতিহ্য সম্পর্কে পূর্বানুমান
বা ভবিষ্যদ্বাণী করে না, যেমনটা দেখা যায় পরবর্তীকালে ডেভিড ম্যানুফ, পিটার ক্যারি
এবং প্যাট্রিক হোয়াইট প্রমুখের লেখায়। ম্যাগউইচের প্রত্যাবর্তনের উপর যে- নিষেধাজ্ঞা
তা শুধুমাত্র শাস্তিমূলক নয়, তা সাম্রাজ্যবাদীও—প্রজাবৃন্দকে অস্ট্রেলিয়ার
মতো জায়গায় নিয়ে যাওয়া যেতে পারে কিন্তু মহানাগরিক বিশ্বে তাদের প্রত্যাবর্তন অননুমোদনযোগ্য- যেমনটা
ডিকেন্সের সমুদয় কথাসাহিত্যে প্রতিফলিত। এই মহানাগরিক
দুনিয়া নিখুঁতভাবে নির্দেশিত, কথিত, অধিকৃত হয়েছে মহানাগরিক ধারাক্রমের ব্যক্তিবর্গের
দ্বারা। সুতরাং একদিকে, হিউজ ও কার্টারের মতো ব্যাখ্যাতাগণ উনবিংশ শতকের ব্রিটিশ লেখায়
অস্ট্রেলিয়ার অপেক্ষাকৃত ক্ষয়িত উপস্থিতির শ্রীবৃদ্ধি ঘটিয়েছেন বিশ শতকে ব্রিটেন
থেকে মুক্ত হওয়া অস্ট্রেলীয় ইতিহাসের পূর্ণতা ও অর্জিত স্বকীয়তার প্রকাশ ঘটিয়ে।
অন্যদিকে, গ্রেট এক্সপেক্টেশনস-এর প্রকৃত পাঠে অবশ্যই লক্ষ করা যাবে, পিপ প্রায়শ্চিত্তস্বরূপ
এই বুড়ো, অতিউদ্যমী, স্বেচ্ছাচারী, দাগি আসামির প্রতি ঋণ স্বীকার করার পরপরই সে নেতিয়ে
পড়ে এবং দুটো পরিষ্কার ধনাত্মক পন্থায় তার পুনর্জীবন ঘটে। নতুন এক পিপ-এর আবির্ভাব
হয় যে পুরোনো পিপ-এর মতো অতীতের ভারে অতটা ন্যুজ নয়-তাকে দেখা যায় শিশু-রূপে যার নামও পিপ; আর পুরোনো পিপ ছোটবেলার
বন্ধু হার্বার্ট পকিটের সাথে কর্মজীবন শুরু করে-এবার আর কর্মবিমুখ ভদ্রলোক হিসেবে নয়,
বরং পরিশ্রমী এক বণিক হিসেবে প্রাচ্যে, যেখানে ব্রিটেনের অন্য উপনিবেশগুলো একধরনের
স্বাভাবিকত্বের আশ্বাস দেয় যা অস্ট্রেলিয়া কখনো দিতে পারেনি। NEXT PART
No comments:
Post a Comment