Edward Said – Life and Works (Bangla)
এডওয়ার্ড সাইড - জীবন ও সাহিত্যকর্ম
১৯৩৫ সালের
১ নভেম্বর এডওয়ার্ড ওয়াদি সাইদের (Edward Wadie Said) জন্ম জেরুজালেমের পশ্চিম অংশে তালবিয়া নামক স্থানে। তার ফিলিস্তিনি খ্রিস্টান
পিতা ওয়াদি সাইদ ছিলেন একজন সফল ব্যবসায়ী। যিনি তাঁর ব্যবসাকেন্দ্র কায়রোতে স্থানান্তর
করেছিলেন কিংবা বলা যায়, করতে বাধ্য হয়েছিলেন। এই সময়ে সাইদ পরিবার কিছুদিন ধরে
তিনটি ভিন্ন জায়গায় বাস করেছিল জেরুজালেম, কায়রো এবং লেবাননের পাহাড়ি নিবাস ধুর
এল-শয়েইর-এ। সাইদের প্রাথমিক পড়াশোনা চলেছে জেরুজালেম ও কায়রোর বেশ ক’টি বিদ্যালয়ে। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে সাইদ
পড়েছেন ইংরেজ শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত ভিক্টোরিয়া কলেজ-এ যেখানে আরব ধনিক
শ্রেণির সন্তানেরা সাধারণত লেখাপড়া করত।
কিশোর বয়সে
সাইদ যে খুব সুশীল ছাত্র ছিলেন, তা নয়। বস্তুত, একাধিকবার তার বিরুদ্ধে নিয়মভঙ্গের
অভিযোগ আনা হয়েছে। এমনকি ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে তাঁকে শৃঙ্খলাভঙ্গের দায়ে বহিষ্কৃত
হতে হয়েছিল। এই ঘটনা সাইদের অভিভাবকদের বাধ্য করেছিল তাকে একপ্রকার নির্বাসনে পাঠাতে।
১৯৫২ সালে তাঁকে যুক্তরাষ্ট্রের নিউ হ্যাম্পশায়ারে অবস্থিত মাউন্ট হারমন নামের প্রিপারেটরি
স্কুলে পাঠানো হয় এবং তখন
থেকে যুক্তরাষ্ট্রই
সাইদের ঘরবাড়ি হয়ে ওঠে।
এরই মধ্যে,
১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠা লাভ করে ইজরায়েল এবং বিশ্ব মানচিত্র থেকে মুছে যায় ফিলিস্তিন
রাষ্ট্রের নাম। ১৯৫০ সালে ইজরায়েলি সরকার অ্যাবসেন্টি প্রপার্টি আইন প্রণয়ন করে যার
দরুন সাইদ পরিবার আরো ৭৫০,০০০ ফিলিস্তিনির মতো সারা জীবনের মতো ঘরছাড়া হয়ে যায়।
ওই আইনের মূল কথা ছিল ১৯৪৮ সালের ১ সেপ্টেম্বরের আগে কোনো ফিলিস্তিনি দেশে ঘরবাড়ি
রেখে এমন কোনো দেশে গিয়ে থাকে যার সঙ্গে ওই সময়ে ইসরায়েলের যুদ্ধ চলছিল, তাহলে সে
তার ঘরবাড়ি ও সম্পত্তি হারাবে। এমন শরণার্থী যাদের সাথে যুদ্ধের প্রত্যক্ষ যোগ ছিল
না তারাও এই আইনের আওতায় পড়েছিল। সাইদ পরিবার তালবিয়া ছেড়ে মিশরে শরণার্থী হয়েছিল
আর সে সময়ে মিশর ইজরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধরত ছিল। ফলে, সাইদ পরিবার আক্ষরিক অর্থেই গৃহচ্যুত
হয়ে পড়ে।
যুক্তরাষ্ট্রে
সাফল্যের সঙ্গে লেখাপড়ার পাট চুকিয়ে সাইদ শিক্ষকতায় যোগ দেন। ১৯৫৭ সালে তিনি প্রিন্সটন
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ব্যাচেলর ডিগ্রি লাভ করেন এবং আঁদ্রে জিদ ও গ্রাহাম গ্রিনের ওপর
অভিসন্দর্ভ লিখে ফাই বিটা কাপ্পা নামক পুরস্কার লাভ করেন।
১৯৫৮ সালে তিনি হার্ভার্ডে উড্রো উইলসন ফেলোশীপ নিয়ে গবেষণায় যোগ দেন। ১৯৬৪ সালে
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে ডক্টরেট ডিগ্রিপ্রাপ্ত হন। ১৯৬৩ সালে
তিনি কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। ১৯৮৯ সালে তিনি সেখানে ওল্ড ডমিনিয়ন ফাউন্ডেশন
অধ্যাপক পদ লাভ করেন। পরে ১৯৯২ সালে ইংরেজি ও তুলনামূলক সাহিত্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের
অধ্যাপক হন। তাঁর পড়ানো বিষয়গুলোর মধ্যে পারসিক এবং আরবি ভাষার সাহিত্যও ছিল। এমনিতে
ইতালীয়, জার্মান, লাতিন, হিস্পানিসহ আরো কয়েকটি ভাষায় তিনি ব্যুৎপন্ন ছিলেন। দীর্ঘ,
সফল ও কর্মময় অধ্যাপনার পাশাপাশি সাইদ তত্ত্ববিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টিকারী বেশ কয়েকটি
গ্রন্থ রচনা করেন যাদের বেশ কয়েকটি আসলে তার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রদান করা বক্তৃতার
পরিমার্জিত রূপ।
প্রধানত
নিউ ইয়র্কে বসবাসকারী সাইদ সেখানে অত্যন্ত পরিচিত ও প্রভাবশালী শিক্ষাবিদ ছিলেন। এই
পরিচিতির সূত্রে প্রায়ই তাকে মধ্যপ্রাচ্য সম্পর্কে বিতর্কে অংশ নিতে হতো। ফিলিস্তিনিদের
জন্য পৃথক একটা আবাসভূমির জন্য যে আন্দোলন ছিল তিনি তার সরব সমর্থক ছিলেন। বহু বছর
ধরে তিনি সমর্থন যুগিয়েছেন ইয়াসের আরাফাতকে যাকে সাইদ প্রকৃত জাতীয়তাবাদী এবং তুখোড়
জনপ্রিয় নেতা হিসেবে গণ্য করতেন। এই সমর্থন আরো গভীর হয় যখন ১৯৭৭ সালে সাইদ পরবাসী
ফিলিস্তিন পার্লামেন্টের সদস্য হন। কিন্তু ১৯৯৩ সালে অসলো চুক্তি স্বাক্ষরিত হবার পর
সাইদ আরাফাতের কট্টর সমালোচকে পরিণত হন। তাঁর মতে ওই চুক্তি ফিলিস্তিনিদের অতি সামান্য ভূমির উপর
প্রায় নিয়ন্ত্রণহীন অধিকার দিয়েছে। অসলো চুক্তি স্বাক্ষর করায় আরাফাতের উপর এতটাই
ক্ষিপ্ত হয়েছিলেন যে, এই উপলক্ষে হোয়াইট হাউজে যে উৎসব হয় তাতে নিমন্ত্রিত হয়েও
উপস্থিত হতে অস্বীকার করেন সাইদ। তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী হোয়াইট হাউজের আনুষ্ঠানিকতার
এই ফ্যাশন শো সুলভ বেলেল্লাপনা এবং মার্কিন প্রেসিডেন্টের বিংশ শতকের একজন রোমান সম্রাটের
মতো দুই করদ মিত্রকে নিয়ে সমঝোতার টেবিলে বসার সঙ্গে তুলনীয় আচরণ আসলে শুধুমাত্র
ফিলিস্তিনিদের বঞ্চনাকে আড়াল করার জন্য। সাইদের মতে, যুক্তরাষ্ট্রে তার জীবনের গতিপথ
পরিবর্তন করে দিয়েছিল ১৯৬৭ সালের আরব ইজরায়েল যুদ্ধ। সেই প্রথম সাইদ নিজেকে আবিষ্কার
করলেন এক বিদ্বেষপূর্ণ জগতের নিঃসঙ্গ ও বহিরিস্থিত বাসিন্দারূপে। তাঁর চারদিকে শুধু
ইজরায়েলের সমর্থকেরা আর আরবদের প্রতি মনোভাব এমন যে, তারা তাদের ন্যায্য পাওনা পাচ্ছে।
সেই বাস্তবতায়
সাইদ একজন সম্মানিত শিক্ষাবিদ হয়ে উঠলেন অপরিচিত এবং সন্দেহের পাত্র। তিনি তাঁর আত্মপরিচয়ের
সংকটকে সম্যক উপলব্ধি করলেন। ফলে, প্রথম তিনি একজন ফিলিস্তিনি হিসেবে নিজেকে নির্মাণ
করতে শুরু করলেন। নিজের মধ্যে তিনি সকল ফিলিস্তিনিকে উপলব্ধি করলেন। তিনি বালফুরের
ঘোষণার অন্তর্নিহিত অর্থ পুরোপুরি বুঝতে পারলেন। পশ্চিমারা যে রাজ্যহীন ইহুদিদের জন্য
মনুষ্যহীন ভূমি হিসেবে ফিলিস্তিনকে গ্রহণ করেছেন তাতে ফিলিস্তিনিদের মানুষ হিসেবে পরিচয়
দিতে একদম অস্বীকার করা হয়েছে। সাইদ বুঝতে পারলেন ব্রিটিশ-ইহুদি পরিচালিত ফিলিস্তিনি
ভূমির জবরদখল ইউরোপীয় উপনিবেশায়নের সুদীর্ঘ ইতিহাসের আরো একটি সাম্প্রতিক উদাহরণ।
তরুণ সাইদের
এই রাজনীতিকায়ন তাঁর লেখালেখির উপর দারুণ প্রভাব ফেলেছে। কেননা, তিনি লক্ষ করেছেন
যে, যে রাজনৈতিক বাস্তবতায় লেখা হচ্ছে তার প্রভাবের বাইরে এমনকি সাহিত্যতত্ত্বও যেতে
পারে না। উপরোল্লেখিত যুদ্ধের প্রায় দশ বছরেরও পরে প্রকাশিত হয় সাইদের বিখ্যাত রচনাত্রয়ী ওরিয়েন্টালিজম (১৯৭৮), দ্য কোশ্চেন অব প্যালেস্টাইন (১৯৭৯), এবং
কাভারিঙ ইসলাম (১৯৮১)। সাইদের মনোবিশ্বে পঠন ও ক্ষমতা নিয়ে যত প্রশ্নের ঘূর্ণিবাত্যা
চলছিল তাদের সকলের প্রেক্ষণবিন্দুতে রাখলেন তিনি ফিলিস্তিনকে। তাঁর লেখা সম্পর্কে সবচেয়ে
গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, ফিলিস্তিন রাষ্ট্র সম্পর্কে, স্বীয় আত্মপরিচয় সম্পর্কে, সাধারণভাবে
ফিলিস্তিনিদের পরিচয়সংকট সম্পর্কে তার যে অনুভব তাকে পাঠবস্তুর তাত্ত্বিক ও সাহিত্যিক
বিশ্লেষণ এবং সেগুলো যেভাবে বাস্তববিশ্বে বর্তমান তা থেকে পৃথক করা যায় না। ফিলিস্তিনকে
নিয়ে তার লেখাজোকাকে আমরা ঘটনাপরবর্তী সাংবাদিকতা বলে এড়িয়ে যেতে কিংবা
তার তত্ত্বকে ফিলিস্তিনি রাজনৈতিক কর্মীর পেশাগত কর্মকাণ্ড বলে খারিজ করতে পারি না।
আবার ফিলিস্তিনের প্রশ্নটাকে ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদের ইতিহাস এবং বিবিধ সমাজে বিভিন্ন
আঙ্গিকে যে উত্তরোপনিবেশী প্রতিরোধ চলমান তার ইতিহাস থেকে আলাদা করাও সম্ভব নয়। সুতরাং
গত কয়েক দশক জুড়ে সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক তত্ত্বের দুনিয়ায় সাইদের অবস্থানকে সম্যক
বুঝতে হলে সাইদের লেখালেখিতে যে পরিচয়ের নির্মাণ ঘটেছে তাকে অবলম্বন করতে হবে। তাঁর
রচনাকর্ম আলোচনা করতে গেলে বুদ্ধিজীবী হিসেবে তাঁর অবস্থান নিরূপণ করতে হবে এমন একজন
রূপে যিনি নির্মাণপদ্ধতি হিসেবে ইতিহাস, সংস্কৃতি ও সাহিত্যের সেই ভূমিকাকে প্রশ্নবিদ্ধ
করেন যখন হেজেমনির সংগঠন আর ক্ষমতাকে ধরে রাখার স্বার্থে তারা নিজস্ব উৎপাদনের প্রতিভূরূপে
হাজির হয়। সমালোচনামূলক এবং রাজনৈতিক অংশগ্রহণের মাধ্যমে ঐতিহাসিক পুনর্নির্মাণের আদর্শের প্রতি অকুতোভয়
পক্ষপাত বুদ্ধিজীবী হিসেবে তাঁর ভূমিকা কিংবা সংস্কৃতি কিংবা আত্মপরিচয়ের সমস্যাগুলোকে
অতিক্রম করে যায়।
সমসাময়িক
সময়ের সবচেয়ে প্রশংসিত ও তীব্রভাবে সমালোচিত এই তত্ত্ববিশারদ ও সাহিত্যসমালোচক ১৯৯১
সালে এক ঘাতক শত্রু মুখোমুখি হন। নিয়মিত চেক আপের সময় তাঁর ডাক্তার তাকে জানান তার
শরীরের লিউকোমিয়া অর্থাৎ ব্লাড ক্যান্সার বাসা বেঁধেছে। ১৯৯৪ সালে তিনি একজন ভারতীয়
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, ডা. কান্তি রায়ের অধীনে চিকিৎসা শুরু করেন। ১৯৯৮ সালে এসে কান্তি
রায় তাকে জানান যে তাঁর রোগটি বিশেষ প্রকৃতির এবং গত চার বছরের কেমোথেরাপি ও রেডিওথেরাপি
তাঁর বিশেষ কাজে আসেনি। এসময়ে বারো সপ্তাহের এক পরীক্ষামূলক চিকিৎসার মধ্য দিয়ে যেতে
হয় তাকে। এই প্রসঙ্গে সাইদ তাঁর বহুসাংস্কৃতিকতার বিষয়টি তুলে ধরে বলেছিলেন যে, তিনি
লঙ আইল্যান্ডে এক ইহুদি হাসপাতাল, ভারতীয় চিকিৎসক ও আইরিশ নার্সদের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা
নিয়েছিলেন।
পরবর্তী
কয়েক বছরে অনেকটা সময় তাকে হাসপাতালে কাটাতে হয়েছে, কিন্তু তার কর্মবহুল জীবন থেমে
থাকেনি। ১৯৯৯ সালে লন্ডন ও বেথলেহেমে বক্তৃতা করে পরিবার ও বন্ধুবান্ধব নিয়ে লেবানন
সফর করেন। সেখানে সীমান্তের কাছে ইজরায়েলিদের পরিত্যক্ত এক ঘাঁটিতে যান। ওখানে গিয়ে
শত শত লেবানীয় দেখতে পান উল্লসিত হয়ে সীমান্তের দিকে পাথর ছুঁড়ছে। সাইদ তাঁর পুত্রের
অনুকরণে নিজেও একখণ্ড পাথর ছোঁড়েন এবং সেই অবস্থায় ক্যামেরাবন্দি হন। এই ছবি পশ্চিমা
সংবাদ মাধ্যমে বিপুল প্রচার পায় এবং সাইদ আরো একবার পশ্চিমা বুদ্ধিবৃত্তিক বিশ্বের
প্রবল সমালোচনার মুখোমুখি হন। এর প্রভাবে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁকে চাকুরিচ্যুত
করার আন্দোলন হয় এবং ভিয়েনাস্থ ফ্রয়েড ইসস্টিটিউট ২০০১ সালে তাদের বার্ষিক ফ্রয়েড
বক্তৃতাদানের নিমন্ত্রণ প্রত্যাহার করে নেয়।
সারাজীবন
নানা সমালোচনা, কটাক্ষ, আত্মপরিচয়ের সংকট ইত্যাদির সঙ্গে লড়াইয়ে বিজয়ী হলেও ঘাতক
ব্যাধি যার সাথে ১৯৯১ সাল থেকে লড়ছিলেন তা তাঁকে জিততে দেয়নি। ২০০৩ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর
নিউ ইয়র্কের এক হাসপাতালে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। আমাদের কালের সবচেয়ে পরিচিত বুদ্ধিজীবী
এবং সবচেয়ে প্রভাবশালী সমালোচক এডওয়ার্ড ওয়াদি সাইদ।
No comments:
Post a Comment