Othello – William Shakespeare – Bangla/Bengali - 1 |
Othello - The Tragedy of Othello, the Moor of Venice – William Shakespeare – Summary in Bengali - Part 1 of 3
ওথেলো, দি মুর অফ ভেনিস
সাইপ্রাসের গভর্নর মনট্যানো খবর পেলেন
যে তার দেশ আক্রমণ করতে সমুদ্রপথে এগিয়ে আসছে অটোমান তুর্কি নৌবাহিনী। খবর পেয়ে অস্থির
হয়ে গেলেন তিনি। প্রতিটি মুহূর্ত কাটাতে লাগলেন চরম অশান্তির মাঝে। তাই আর দেরি না
করে তিনি তার প্রভু ভেনিসের ডিউককে জানিয়ে দিলেন তুর্কি নৌবাহিনীর সম্ভাব্য আক্রমণের
কথা।
মনট্যানোর প্রেরিত সংবাদ পেয়ে রাত দুপুরে
সেনেটরদের এক জরুরি সভার আয়োজন করলেন ভেনিসের ডিউক। সাইপ্রাস দখল করতে দ্রুত এগিয়ে
আসছে তুর্কি নৌবাহিনী। তারা নাকি ইতিমধ্যেই রোডস দ্বীপের কাছে পৌছে গেছে। এ সমস্ত সংবাদ
শুনে আঁতকে উঠলেন সেনেটের সদস্যরা। কারণ তারা জানতেন তুর্কিরা যোদ্ধা হিসেবে দুর্ধর্ষ।
জলে বা স্থলে, তাদের সাথে লড়াইয়ে টিকে থাকা দুষ্কর। তারা এও জানতেন জলযুদ্ধে
পৃথিবীর সেরা ব্রিটিশ নৌবাহিনী পর্যন্ত লেজ গুটিয়ে সরে পড়ে যদি তারা দূর থেকে দেখতে
পায় তুর্কি নৌবহরের জাহাজ।
সেনেটের সদস্যদের দিকে তাকিয়ে বললেন ডিউক, এ বিপদে আমাদের একমাত্র আশা ভরসা সেনাপতি ওথেলো। কাজেই তুর্কি আক্রমণ রোধ করতে তাকেই নেতৃত্ব দিয়ে পাঠানো হোক সাইপ্রাসে।
সেনেটের সবাই একবাক্যে সমর্থন করল ডিউকের প্রস্তাব! ডিউকের নির্দেশে তার
সৈন্যেরা তখনই রওনা হল ওথেলোকে সংবাদ দিতে।
ভেনিসের অধিবাসী হলেও ওথেলো কিন্তু আর
সবার মতো সাদা চামড়ার লোক নন, তার গায়ের রং কালো। আফ্রিকার মরক্কোতে তার দেশ। তিনি জাতিতে মুর। যৌবনে তিনি ভাগ্যান্বেষণে
এসেছিলেন ভেনিসে। সেখানেই গ্রহণ করেন সৈনিকের পেশা। বহু লড়াইয়ে নিজের সাহস আর রণকৌশলের
স্বাক্ষর রেখে জীবনে বহু উন্নতি করেছেন তিনি। তাই বিদেশি হয়েও সেনাপতির পদ পেতে কোনও
অসুবিধে হয়নি তার।
ডিউকের সৈন্যরা ছাড়াও সে সময় আরও কিছু
লোক খুঁজে বেড়াচ্ছিল ওথেলোকে। তাদের মধ্যে ছিলেন সেনেটের অন্যতম সদস্য ব্রাবনশিও আর
তার পরিচিত কিছু লোক। ওথেলোকে এত রাতে খুঁজে বেড়াবার কারণ একটাই --- কিছুক্ষণ আগে ব্রাবনশিও জানতে পেরেছেন যে তার পরমাসুন্দরী কন্যা ডেসডিমোনা
কাউকে কিছু না বলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে। তারপর সবার নজর এড়িয়ে শহরের কোনও এক জায়গায়
গোপনে বিয়ে করেছে ভেনিসের প্রধান সেনাপতি ওথেলোকে। সেনাবাহিনীর এক পদস্থ অফিসারই কে
এ খবরটা দিয়েছেন -- তার নাম ইয়াগো। ব্রাবানশিওর কানে খবরটা তুলে দেবার সময় ইয়াগোর সাথে ছিল ভেনিসের
এক ধনীর অপদার্থ পূত্র রডরিগো।
খবরটা শুনে প্রথমে বিশ্বাস করতে চাননি
সেনেটর ব্রাবানশিও। কিন্তু যখন খোঁজ নিয়ে জানলেন যে সত্যিই ডেসডিমোনা বাড়িতে নেই, স্বাভাবিক ভাবেই তখন তার মনে সন্দেহ হল। তিনি ভেবে দেখলেন ইয়াগোর দেওয়া
খবর সত্যি হলেও হতে পারে। তিনি লক্ষ করেছিলেন বেশ কিছুদিন ধরে ওথেলো প্রায়ই তার বাড়িতে
আসছেন। ওথেলো নামি লোক, দেশের প্রধান সেনাপতি। তার মতো লোক
বাড়িতে আসায় খুবই গর্ববোধ করতেন ব্রাবানশিও। আর ডেসডিমোনাও যে ওথেলোকে খুব পছন্দ করে,
সেটাও তার নজর এড়ায়নি। ওথেলো আসার খবর পেলে যেখানেই থাক ডেসডিমোনা
এসে হাজির হত, ওথেলোকে নিয়ে যেত তার নিজের মহলে। ওথেলোর জীবনের
নানা রোমাঞ্চকর কাহিনি শোনানোর জন্য আবদার করত তার কাছে। বীরপুরুষদের মুখ থেকে তাদের
জীবনের রোমাঞ্চকর কাহিনি শোনার জন্য অল্পবয়সি মেয়েরা খুবই উৎসুক হয় - সেজন্য এর মধ্যে দোষণীয় কিছু খুঁজে পাননি ব্রাবানশিও। কিন্তু নিরালায় পরস্পরের
মাঝে কথাবার্তার সুবাদে যে প্রেম-ভালোবাসা গড়ে উঠেছিল তা আজই
টের পেলেন ব্রাবানশিও। তারই সমাপ্তি আজ এই গোপন বিয়ের অনুষ্ঠানে। যত মানী লোকই হোন না কেন ওথেলো,
ডেসডিমোনার সাথে তার বিয়েটা কিছুতেই মন থেকে মেনে নিতে পারছেন না
ব্রাবানশিও। একে তো ওথেলো বিধর্মী ও বিদেশি, আর ডেসডিমোনা
তার মেয়ের সমান। এক্ষেত্রে কিছুতেই তাদের বিয়েটাকে মেনে নিতে পারেন না তিনি। ডেসডিমোনাকে
ওথেলোর হাত থেকে উদ্ধার করে আনতে নিজেই লোকজন জোগাড় করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছেন তিনি। দুটি দলই কিছুক্ষণ বাদে খুঁজে
পেল ওথেলোকে। ডিউকের সৈন্যরা জানাল যে একটা বিশেষ কাজে রাত-দুপুরে তাকে ডেকে পাঠিয়েছেন ডিউক। আর ব্রাবানশিও বললেন বাড়ি থেকে তার মেয়ে
ডেসডিমোনাকে ফুসলিয়ে আনার অভিযোগে আজ রাতেই তিনি আদালতে হাজির করবেন ওথেলোকে।
এদিকে ওথেলোর নিজস্ব লোকজনও কম ছিল না।
তারা সবাই বলল, ডিউক এমনিই ডেকে পাঠিয়েছেন তাকে। ওথেলোর বিরুদ্ধে যদি সত্যিই
ব্রাবানশিওর কোনও অভিযোগ থেকে থাকে, তাহলে তিনি তো অনায়াসেই
সেটা পেশ করতে পারতেন ডিউকের সামনে।
ডিউকের কাছে নিজেই এলেন ওথেলো। সেই সাথে ব্রানশিও এলেন ওথেলোর বিরুদ্ধে ডিউকের কাছে নালিশ জানাতে।
সাইপ্রাসের ধারে-পাশে আসার আগেই কীভাবে তুর্কি বাহিনীকে হঠানো
যায় তা নিয়ে রাতের ঘুম বিসর্জন দিয়ে ডিউক ও তার পারিষদরা যখন আলোচনায় রত, ঠিক সে সময় ওথেলোর বিরুদ্ধে তার মেয়েকে ফুসলিয়ে নিয়ে যাবার অভিযোগ ডিউকের
কাছে পেশ করলেন ব্রানশিও।
মহা ফ্যাসাদে পড়ে গেলেন ডিউক। তুর্কি
আক্রমণ রোখাটা যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি সেনেটর হিসেবে ব্রাবানশিওর অভিযোগের
গুরুত্বকে ছোট করে দেখাও তার পক্ষে সম্ভবপর নয়। অনেক ভেবে চিন্তে ডিউক এই সিদ্ধান্তে এলেন যে ব্রাবানশিওর অভিযোগের
বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত অন্য কাজে হাত দেওয়া তার পক্ষে ঠিক হবে না।
এরপর অন্যান্য সেনেটরদের সামনে ডিউকের
কাছে ওথেলোর বিরুদ্ধে তার অভিযোগ শোনালেন ব্রাবানশিও। তিনি বললেন, ‘আফ্রিকার
লোক হিসাবে ওথেলো নিশ্চয়ই জাদু ও তুকতাক জানে। বিধর্মী হয়েও এই জাদুবলের সাহায্যে সে
ডেসডিমোনাকে বশ করে গোপনে বিয়ে করেছে তাকে। এ অত্যন্ত গর্হিত অপরাধ ওথেলোর পক্ষে। আমি
চাই আগে এ অপরাধের বিচার হোক।’
সেই সামন্ততান্ত্রিক যুগে ধনী-দরিদ্র
সবার খুব বিশ্বাস ছিল তুকতাক ও জাদুমন্ত্রের উপর। তাই সেনেটের অনেকেই মেনে নিলেন যে
সত্যি কথাই বলছেন ব্রাবানশিও। আর আফ্রিকা এক অন্ধকারাচ্ছন্ন দেশ, শিক্ষা-সভ্যতার আলো পৌঁছায়নি সেখানে। সেখানকার
লোকেরা ভূত প্রেতের পূজো করে, তুকতাক, জাদুমন্ত্র তাদের দৈনন্দিন জীবনের সাথে গভীরভাবে জড়িয়ে আছে। ওথেলোর বাড়িও
আফ্রিকার মরক্কোয়। কাজেই ও
সব অপবিদ্যায় তার দখল থাকা মোটেই বিচিত্র নয়। নইলে কী করে বিশ্বাস করা যায় যে ডেসডিমোনার মত পরমাসুন্দরী এক
মেয়ে কালো কুচ্ছিত মুরকে স্বেচ্ছায় বিয়ে করবে! অথচ ডেসডিমোনাকে বিয়ে করার
স্বপ্ন দেখেনি, এমন যুবক একজনও খুঁজে পাওয়া যাবে না ভেনিস
শহরে, তাদের মধ্যে অনেকেই ভালোবাসার বন্ধনে বাঁধতে চেয়েছিল
তাকে। কিন্তু তাদের কাউকে পাত্তা দেয়নি ডেসডিমোনা।
রডরিগো সেই যুবকদের একজন যে ইয়াগোর সাথে
ব্রাবানশিওর কাছে গিয়েছিল ওথেলোর বিরুদ্ধে নালিশ জানাতে। এ পরিপ্রেক্ষিতে সবাই ধরে
নিল যে তুকতাক করেই ডেসডিমোনার ভালোবাসা আদায় করেছেন ওথেলো আর তারপর তাকে বাধ্য করেছেন
বিয়ে করতে।
সব কিছু শোনার পর ডিউক বললেন, ‘সেনাপতি
ওথেলো,
আপনার বিরুদ্ধে সেনেটার ব্রাবানশিও যে অভিযোগ করেছেন সে ব্যাপারে
আপনার কি কিছু বক্তব্য আছে?’
‘এ ব্যাপারে শুধু একটা
কথাই আমি বলতে চাই হুজুর যে বিভিন্ন যুদ্ধে আমার বীরত্বের কথা শুনেই ডেসডিমোনা আকৃষ্ট
হয়েছে আমার প্রতি। আমার কথা সত্যি কিনা তা ডেসডিমোনাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেই জানতে পারবেন’ – বললেন
ওথেলো।
বিচারকের আসনে বসা ডিউক যুক্তি খুঁজে
পেলেন ওথেলোর কথার মাঝে। তিনি বললেন, ‘নিশ্চয়ই
ওথেলো,
আমরা বাধ্য ডেসডিমোনার বক্তব্য শুনতে। কে আছ, ডেসডিমোনাকে ডেকে নিয়ে এস এখানে।’
ডিউকের সেপাই তখনই রওনা হল ডেসডিমোনাকে
নিয়ে আসতে। ইত্যবসরে উকিলের সাহায্য ছাড়াই আত্মপক্ষ সমর্থনের সিদ্ধান্ত নিলেন ওথেলো। এ ব্যাপারে তিনি যে নির্দোষ তা প্রমাণ করার জন্য তিনি ডিউক এবং
সেনেটরদের সামনে ঘটনার আনুপূর্বিক যুক্তিগ্রাহ্য বিবরণ দিতে লাগলেন।
নিজের নির্দোষিতা প্রমাণ করার জন্য ওথেলো
বলতে লাগলেন, মহামান্য ডিউক এবং মাননীয় সেনেটরদের কাছে আমার গোপন করার
কিছু নেই। ডেসডিমোনার ভালোবাসা পাবার জন্য আমি তুকতাক বা ওই জাতীয় কোনও নীচ কাজের আশ্রয়
নেইনি। শুধু এই নয়, আমি কোনও রকম চেষ্টাও করিনি ডেসডিমোনার
ভালোবাসা পাবার। জরুরি কাজের জন্য একবার আমায় যেতে হয়েছিল সেনেটর ব্রাবানশিওর বাড়িতে।
সেখানেই দেখা হয়েছিল ডেসডিমোনার সাথে। বহু যুদ্ধ জয় করে ভেনিসের প্রধান সেনাপতি হবার
পর থেকেই সে আগ্রহী হয়ে ওঠে আমার সম্পকে। তার একটা কারণও অবশ্য ছিল --- জ্ঞান হবার পর থেকে বড়ো হবার সময় পর্যন্ত যে সব পুরুষ মানুষের সাক্ষাৎ
পেয়েছে ডেসডিমোনা, চেহারার দিক দিয়ে আমি তাদের চেয়ে সম্পূর্ণ
পৃথক। আমার জাতি, ধর্ম, চামড়ার রং,
মুখের গড়ন, চুলের ধাঁচ -- সবকিছুই আর পাঁচজন থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। তার উপর ও জেনেছে যে আমি মরক্কোর
লোক, যে দেশটা আফ্রিকার অন্তর্ভুক্ত। হুজুর, আফ্রিকার অধিকাংশই ঘন জঙ্গলে ভরা। বাঘ, সিংহ,
হাতি, বাইসন, সাপ,
নেকড়ে ---- এসব হিংস্র পশুরা অবাধে ঘুরে
বেড়ায় সেখানে। এমন দেশ থেকে আসা একটা মানুষের প্রতি ডেসডিমোনার মতো যুবতি যে সহজেই
আকৃষ্ট হবে তাতে আশ্চর্যের কি আছে? তাছাড়া ডেসডিমোনাকে আমি
যখন দেখি, তখন সে যৌবনে পা দেওয়া এক কুমারী। সামাজিক বিধি-নিষেধ সম্পর্কে তার অভিজ্ঞতা থাকা তো দূরের কথা, কোনও ধ্যান-ধারণাই গড়ে ওঠেনি তার মনে। আমার ধারণা,
এসব কারণেই সে আগ্রহী হয়ে উঠেছিল আমার জীবনের কথা শুনতে।
‘হুজুর, সৈনিক হলেও আমি একজন রক্তমাংসের মানুষ। ভালোবেসে যদি কেউ যুদ্ধের কাহিনি
শুনতে চায় তাহলে তাকে বিমুখ করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আমি তাকে দিনের পর দিন শুনিয়েছি খুব ছোটবেলায় দেশ ছেড়ে ভেনিসে
এসে কীভাবে আমি সৈনিকের বৃত্তি গ্রহণ করেছি, বিভিন্ন যুদ্ধ জয় করে কীভাবে
আমি আজ ভেনিসের প্রধান সেনাপতি হয়েছি -- এসব বিভিন্ন ঘটনার
কথা বলেছি তাকে। কর্মসূত্রে ওর বাবার কাছে যখনই গিয়েছি, কাজ
শেষ হবার পর ডেসডিমোনা আমায় টেনে নিয়ে গেছে তার মহলে। বাচ্চা মেয়ের মতো বায়না ধরেছে
গল্প শোনার। যুদ্ধের বর্ণনা শুনতে শুনত আমার প্রতি ভালোবাসার যে ছবি ওর দু-চোখে ফুটে উঠত, সেটা আমার নজর এড়ায়নি। হুজুর,
বিধর্মী হয়েও আমি বলছি ডেসডিমোনার ভালোবাসা পেয়ে আমি সত্যিই ধন্য।
কোনও তুকতাক বা জাদুমন্ত্র নয় হুজুর, আমর বীরত্বের কাহিনিগুলি
একসময় আমারই অজান্তে জয় করেছে ডেসডিমোনার হৃদয়। হে মহামান্য ডিউক, নিজের নির্দোষিতার পক্ষে
আমার আর কিছু বলার নেই।’
ওথেলোর বক্তব্য শেষ হবার সাথে সাথেই সেপাই
সহ ডিউকের সামনে এসে হাজির হল ডেসডিমোনা।
গম্ভীর স্বরে তাকে প্রশ্ন করলেন ডিউক, ‘তুমিই ডেসডিমোনা?’
‘হ্যা, মহামান্য ডিউক,’ স্বাভাবিক
স্বরে উত্তর দিল ডেসডিমোনা।
ডেসডিমোনার চোখের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন
ডিউক,
আচ্ছা, সেনাপতি ওথেলো কি কখনও তোমায় বিয়ের
প্রস্তাব দিয়েছিলেন?
‘না, মাননীয় ডিউক, একই ভাবে জবাব দিল ডেসডিমোনা,
‘সেনাপতি নন, বরং আমিই বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলাম তাকে।
সে প্রস্তাব গ্রহণ করে আমায় সম্মানিত করেছেন ওথেলো। একমাত্র আমার অনুরোধেই তার জীবনের রোমাঞ্চকর ঘটনাগুলি শুনিয়েছে
আমাকে। এ ছাড়া বিয়ের কোনও বাসনাও তিনি প্রকাশ করেননি আকার ইঙ্গিতে।
ডেসডিমোনার বক্তব্য শুনে সমবেত সেনেটররা
সবাই একবাক্যে বললেন। ডেসডিমোনার সাক্ষোই প্রমাণ হল যে ওথেলো সম্পূর্ণ নির্দোয়। তারা প্রস্তাব দিলেন ওথেলোর উপর থেকে ব্রাবানশিওর অভিযোগ খারিজ
করে দিয়ে আসন্ন সংকটের মোকাবিলার দায়িত্ব দেওয়া হোক তাকে।
সেনেটরদের ইচ্ছায় সায় দিয়ে ওথেলোর বিরুদ্ধে
আনা ব্রাবানশিওর অভিযোগ খারিজ করে দিলেন ডিউক। তুর্কি নৌবাহিনী যে সাইপ্রাস আক্রমণ
করতে আসছে সে কথাও তিনি শুনিয়ে দিলেন ওথেলোকে। ওথেলোকে ডিউক আরও জানালেন যে সাইপ্রাস
রক্ষার দায়িত্ব নিতে হবে তাকেই। ডিউকের কথা শুনে ওথেলো বললেন যে তিনি তৈরি আছেন যুদ্ধের
জন্য।
এবার ওথেলোকে বললেন ডিউক, সেনাপতি ওথেলো, সাইপ্রাস দুর্গের সামগ্রিক অবস্থার
খুটি-নাটি পর্যন্ত আপনার নখদর্পণে, সে কথা আমার অজানা নয়। সাইপ্রাসকে
শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করতে গিয়ে আপনার মধুচন্দ্রিমা হয়ত কিছুটা বিঘ্নিত হবে, সেজন্য আমি এবং সেনেটররা সবাই খুব দুঃখিত।
‘আমি কথা দিচ্ছি মহামান্য
ডিউক,
তুর্কি নৌবাহিনীকে সাইপ্রাসের আশে-পাশেও
ঢুকতে দেব না,’ বললেন ওথেলো, ‘আমি এখনই
যাচ্ছি। যাবার আগে অনুরোধ করছি আপনারা আমার স্ত্রীর নিরাপত্তার দায়িত্ব নিন।’
‘এ আর এমন
কি ব্যাপার?’ বললেন ডিউক, ইচ্ছে করলে আপনি অনায়াসেই
স্ত্রীকে রেখে যেতে পারেন তার পিতা সেনেটর ব্রাবানশিওর কাছে। ব্রাবানশিও বললেন, ‘আমায় মাফ
করবেন মহামান্য ডিউক।’ ডেসডিমোনাকে আর আমার
কাছে রাখা সম্ভব নয়।
‘আমিও তা চাই না,’ ব্রাবানশিওর
মতে সায় দিয়ে বললেন ওথেলো।
ডেসডিমোনা বললেন, আমিও চাইনা বাবার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার কাছে গিয়ে থাকতে। যাকে ভালোবেসে ঘর
ছেড়েছি, দয়া করে তার কাছাকাছি থাকার অনুমতি দিন আমায়।
‘মাননীয় ডিউক, আমারও ইচ্ছা তাই,’ বললেন ওথেলো। ডিউক বললেন ওথেলোকে, ‘বেশ, তাই হবে। আজ রাতেই আপনি রওনা হয়ে যান সাইপ্রাস অভিমুখে। যাবার আগে অধীনস্থ
কোনও সেনানীকে দায়িত্ব দিন যাতে সে সাইপ্রাসে আপনার স্ত্রীকে পৌছে দেয়।’
সেনানী ইয়াগোর উপর ডেসডিমোনাকে নিরাপদে
সাইপ্রাসে পৌঁছে দেবার দায়িত্ব দিয়ে তুর্কি আক্রমণ রুখতে সেই রাতেই জাহাজ নিয়ে সাইপ্রাসের
দিকে রওনা দিলেন ওথেলো।
সেনানী হিসেবে যতই দক্ষতা থাক না কেন
ইয়াগোর,
লোক হিসেবে সে ছিল এক নম্বরের বদমাশ। ওথেলো যখন ভেনিসের প্রধান সেনাপতি
নিযুক্ত হন, সে সময় ইয়াগো চেষ্টা করেছিল তার প্রধান সহকারী
হবার। কিন্তু তার সব চেষ্টা ব্যর্থ করে ওথেলো তার প্রধান সহকারী রূপে বেছে নেন ক্যাসিও
নামে অপর একজন সেনানীকে। তবে ওথেলো একেবারে হতাশ করেননি ইয়াগোকে। তিনি তাকে বহাল করেন
অধস্তন এক সেনানীর পদে। ইয়াগো মোটেও ভুলতে পারেনি সেই তিক্ত ঘটনার স্মৃতি। অনেক দিন
থেকেই সে মনে মনে রাগ পুষে রেখেছে ওথেলোর উপর। বাইরে লোক দেখানো আনুগত্যের ভাব দেখালেও,
সে দিন-রাত মাথা খাটিয়ে চলেছে কী ভাবে ওথেলোর
চরম সর্বনাশ করা যায়। ডেসডিমোনাকে
বিয়ে করবেন বলে যে রাতে ওথেলো তাকে তার বাবার বাড়ি থেকে বের করে নিয়ে যান, সে সময় ইয়াগোও ছিল তার সাথে, ইয়াগোর সক্রিয় সহযোগিতা
ছাড়া ওথেলোর পক্ষে সম্ভব ছিল না ডেসডিমোনাকে বিয়ে করার। অথচ বিয়ের কিছুক্ষণ পরে এই
ইয়াগোই সে সংবাদটা পৌছে দেন ডেসডিমোনার বাবা সেনেটর ব্রাবানশিওর কানে। এই ইয়াগোই সেনেটর
ব্রাবানশিওকে পরামর্শ দিয়েছিল ডিউকের কাছে ওথেলোর বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাতে। সব শোনার
পর ডিউক ওথেলোকে কঠোর সাজা দেবেন এটাই ছিল ইয়াগোর আশা।
এ কথা আগেই বলা হয়েছে যে ভেনিসের ধনী
ব্যক্তিদের যে সব অপদার্থ ছেলেরা এতদিন ধরে স্বপ্ন দেখেছিল ডেসডিমোনাকে বিয়ে করার, রডরিগো তাদের অন্যতম। জাদুমন্ত্রে ডেসডিমোনাকে বশীভূত করে ওথেলো তাকে বিয়ে
করেছে – এ খবরটা ব্রাবানশিওর কানে তুলে দিতে যে রাতে ইয়াগো তার কাছে
গিয়েছিল, মজা দেখার জন্য সে সময় রডরিগোও ছিল তার সাথে। ডেসডিমোনার
সাথে বিয়ে দেবার লোভ দেখিয়ে ইয়াগো প্রচুর টাকা হাতিয়েছে রডরিগোর মাথায় হাত বুলিয়ে। ডেসডিমোনা তাকে বিয়ে করতে রাজি না হলেও এতদিন আশায় আশায় থেকেছে
রডরিগো। কিন্তু যখন শুনল ডেসডিমোনা বিয়ে করেছে
ওথেলোকে,
তখন নিরাশায় ভেঙে পড়ল সে।
ইয়াগো দেখল এই সুযোগ, রডরিগোর মাথায় হাত বুলিয়ে
আরও কিছু টাকা হাতাবার। সে তাকে আশ্বাস দিয়ে বলল, রডরিগো,
মিছিমিছি ভেঙে পড়ছ তুমি। ডেসডিমোনার সাথে ওথেলোর বিয়ে হওয়ায় তোমার
মন খারাপ করার কিছু নেই। আমি বলছি ওদের পরস্পরের প্রতি ভালোবাসাটা একটা খেয়াল মাত্র।
ওদের বিয়েটা বেশিদিন টিকবে না। একটু অপেক্ষা কর, ওদের ছাড়াছাড়ি
হল বলে। দিনরাত এখন শুধু একটাই কাজ করতে হবে তোমায় - তা হল
সাইপ্রাসে গিয়ে ডেসডিমোনার পিছনে লেগে থাকা। তার প্রতি তোমার ভালোবাসা যে অটুট,
তারই খোঁজে যে তুমি সাইপ্রাসে এসেছে এটা ভালো করে বোঝাতে হবে ডেসডিমোনাকে।
আর তার চোখে চোখ পড়লেই ইশারা, হাবেভাবে বুঝিয়ে দেবে যে এখনও
তুমি ভালোবাস তাকে।
No comments:
Post a Comment