King Lear – William Shakespeare – Bangla Translation |
কিং লিয়ার - উইলিয়াম শেক্সপিয়ার - বাংলা অনুবাদ - ১
দেশ শাসনের দায়ভার থেকে মুক্তি পাবার
জন্য ইংল্যান্ডের বৃদ্ধ রাজা লিয়ার যখন তার তিন মেয়ে, দুই জামাই ও অমাত্যদের সাথে নিয়ে রাজসভায় প্রবেশ করলেন, তখন সেখানে বসে নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করছিলেন লর্ড অব কেন্ট এবং লর্ড অব
গ্লচেস্টার।
কথার ফাকে একসময় গ্লচেস্টারকে জিজ্ঞেস
করলেন কেন্ট, ‘আচ্ছা মাননীয় গ্লচেস্টার, আলবেনিয়ার ডিউক আর কর্নওয়ালের
ডিউক, এই দুই জামাইয়ের মধ্যে রাজার কাছে কে সবচেয়ে প্রিয় তা
কি আপনি আন্দাজ করতে পারেন?
‘না, প্রিয় বন্ধু’ মাথা নেড়ে বললেন গ্লচেস্টার,
এ ব্যাপারে সঠিক অনুমান করা কঠিন, কারণ দুজনেই
সমান গুণী, কেউ কারও চেয়ে কম বা বেশি নন।’
সে সময় গ্লচেস্টারের পাশে বসে থাকা এক
তরুণকে দেখে বললেন কেন্ট, ‘ওই যুবকটি কি আপনার পুত্র?’
গ্লচেস্টার বললেন, হ্যা। তবে ওকে ছেলে বলে মেনে নিতে আমার লজ্জা হয়। তারপর একটু দোনোমোনো ভাবে বললেন, ‘ওর আচার-আচরণ
খুবই খারাপ। তবে ওর বড়ো ভাই আমার প্রিয়পাত্র।’
এবার ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন, শোন এডমন্ড, ইনি হচ্ছেন আমার প্রিয় বন্ধু,
কেন্টের লর্ড।
‘আপনি যখন
বাবার বন্ধু, তখন আমারও পূজনীয়,’ বললেন
এডমন্ড।
কেন্ট বললেন, ‘আশা করি
ভবিষ্যতে তোমার উপর আমার স্নেহ আরও বেড়ে যাবে।’
বিশিষ্ট অতিথিদের অভ্যর্থনার উদ্দেশ্যে
রাজা ঘরে ঢুকেই চলে যেতে বললেন গ্লচেস্টার ও এডমন্ডকে। তারা চলে যাবার পর রাজা কিছুক্ষণ
চোখ বুলালেন সাথে নিয়ে আসা সীমানাসহ অঙ্কিত রাজ্যের মানচিত্রের উপর। তারপর উপস্থিত
সবার সামনে তিন মেয়ে ও দুই জামাইকে লক্ষ্য করে বললেন, হে আমার মেয়ে জামাইরা! আমি স্থির করেছি রাজার দায়িত্ব-কর্তব্য থেকে মুক্ত হয়ে আমার বুড়ো বয়স অর্থাৎ শেষ জীবনটা আনন্দে কাটাব।
সে জন্য আমি সমান তিন ভাগে ভাগ করেছি আমার সাম্রাজ্যকে। এ নিয়ে ভবিষ্যতে যাতে তোমাদের
মধ্যে বিবাদ না হয় তাই এই তিন ভাগ আমি দান করে দিতে চাই আমার তিন কন্যাকে। সেই সাথে
কর্ডেলিয়ার পাণিপ্রার্থী ফ্রান্স ও বুর্গান্ডির রাজকুমারের প্রতীক্ষার অবসানও করতে
চাই আমি। কিন্তু তার আগে বল, তোমরা আমায় কে কতটুকু ভালোবাস?
রাজার বড়ো মেয়ে গনেরিল বলল সবার আগে, মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড়ো অভিশাপ হল অন্ধত্ব, বন্দিদশা এবং মৃত্যু। এ জীবনে
যদি আপনার স্নেহ না পাই, তাহলে স্নেহহীন সে জীবন আমার কাছে ভীষণ কষ্টকর
বলে মনে হবে। সন্তানের প্রতি পিতার স্নেহ-ভালোবাসা যে কোনও
সন্তানই কামনা করে।
এ কথা শুনে খুব খুশি হলেন রাজা। আনন্দের
চোখে তিনি মেয়েকে দান করে বসলেন শস্যশ্যামলা এক বিশাল রাজ্য। তারপর মেজ মেয়ে রিগানকে
বললেন,
‘এবার বল, তুমি আমায় কতটুকু ভালোবাস?’
রিগান উত্তর দিল, বাবা, আমার প্রতি আপনার যে ভালোবাসা তার পরিমাপ করার সাধ্য আমার নেই, আর আমি সে চেষ্টাও করব না। তবে জেনে রাখুন, মানুষের
জীবনে যত কিছু আনন্দ আছে, সে সবই আমার কাছে বিষের মতোই মনে
হবে, যদি আমি বঞ্চিত হই আপনার স্নেহ থেকে।
স্নেহ-দুর্বল বাবা খুব খুশি
হলেন মেয়ের কথা শুনে। তিনি রিগানকেও দান করলেন সাম্রাজ্যের এক সমৃদ্ধিশালী অংশ। সবশেষে
তিনি উৎসাহ আর আনন্দের সাথে আদরের ছোটো মেয়েকে বললেন সে যেন জানায় বাবাকে সে কতটুকু
ভালোবাসে।
কর্ডেলিয়া বলল, ‘মেয়ে হিসেবে
বাবাকে যতটুকু ভালোবাসা দরকার, আমি ততটাই ভালোবাসি আপনাকে।
আদুরে ছোটো মেয়ের মুখে শোনা কথা কেন জানি
অবিশ্বাস্য মনে হতে লাগল রাজা লিয়ারের। তার মনে হল এক ঝটকায় তিনি যেন স্বপ্ন থেকে ছিটকে
পড়েছেন শক্ত মাটিতে। তিনি ছোটো মেয়েকে বললেন, আরও একবার ভেবে বল কর্ডেলিয়া,
তুমি কি এর চেয়ে বেশি ভালোবাস না আমায়?
দৃঢ় কণ্ঠে উত্তর দিল কর্ডেলিয়া, ‘আমার যা
বলার ছিল তা আমি ভেবে-চিন্তেই বলেছি। যদি আপনাকেই মন-প্রাণ দিয়ে ভালোবাসতে হয়, তাহলে স্বামী ও অন্যান্যদের
প্রতি আমার ভালোবাসা কর্তব্য বলে কিছুই থাকে না। আর সেটা হবে খুব অন্যায় কাজ। তাই আমি
পারি না সমস্ত মন-প্রাণ দিয়ে আপনাকে ভালোবাসতে।’
কর্ডেলিয়ার কথা বোধগম্য না হওয়ায় রাজা
রেগে গিয়ে বললেন তাকে, ‘তোমার মনের
কথা যদি এই হয়, তাহলে ঈশ্বরের দোহাই, আজ থেকে
তোমার-আমার সম্পর্ক শেষ। তোমার সাথে আমার আচরণও সেরূপ নির্মম
হোক, যে আচরণ অসভ্য স্কাইলিয়া করেছিল রানির সাথে। তুমি এই
মুহুর্তে দূর হয়ে যাও আমার চোখের সামনে থেকে।’
এর মধ্যে প্রভুভক্ত কেন্ট কিছু বলতে যেতেই
চিৎকার করে তাকে থামিয়ে দিলেন রাজা লিয়ার। তারপর বললেন জামাইদের, ‘প্রিয় ছেলেরা, এবার শেষ তৃতীয় ভাগটা নিজেদের মধ্যে সমান ভাগে ভাগ করে নাও তোমরা। আমি পালা
করে তোমাদের দুজনের সাথে থাকব একশো অনুচর নিয়ে। আমার মাথায় মুকুটটাকে দু-ভাগ করে সমস্ত সম্পদ ও ক্ষমতা
তোমাদের দান করলাম। আমার জন্য রইল শুধু রাজা উপাধিটা। তারপর সভাসদদের দিকে ফিরে বললেন,
‘তোমরা যে কেউ একজন গিয়ে ডেকে আন ফ্রান্স ও বুর্গান্ডির দুই যুবরাজকে।’
কেন্ট বললেন, এরূপ অবিবেচকের মতো কাজ আপনি করবেন না প্রভু। একটু ভেবে দেখুন, তাহলে বুঝতে পারবেন আপনার প্রিয় ছোটো মেয়ে আপনাকে সত্যিই ভালোবাসে।
কর্ডেলিয়া সম্পর্কে এ কথা বলতেই রাজা
তলোয়ার দিয়ে মেরে ফেলতে চাইলেন কেন্টকে। কেন্ট বললেন, প্রাণের ভয়ে আমি কিছুতেই মিথ্যে কথা বলতে পারব না প্রভু। আপনি যে ভুল করছেন
সে কথা যতক্ষণ পর্যন্ত আমার দেহে প্রাণ আছে আমি বলে যাব।
এত রেগে গেছেন রাজা লিয়ার যে স্বাভাবিক
জ্ঞানটুকুও হারিয়ে ফেলেছেন তিনি। তাই তিনি তার পরম বন্ধু কেন্টকে বলতে পারলেন, তুমি একটা রাজদ্রোহী দূবৃত্ত ছাড়া আর কিছু নও। দেশ থেকে আমি তোমাকে নির্বাসিত
করলাম তোমার উদ্ধত আচরণের জন্য। আগামী পাঁচ দিনের মধ্যে তোমায় এই দেশ ছেড়ে চলে যেতে
হবে, অন্যথায় মৃত্যু হবে তোমার।
কন্যাসম কর্ডেলিয়াকে আশীর্বাদ করে চোখের জল মুছতে মুছতে রাজসভা থেকে বিদায়
নিলেন কেন্ট।
এ সময় শোনা গেল নেপথ্যে কথাবার্তার আওয়াজ।
দুই যুবরাজ আর তাদের অনুচরদের নিয়ে প্রবেশ করলেন গ্লচেস্টার।
রাজা লিয়ার তাদের দেখে বললেন, হে বুর্গান্ডির যুবরাজ! আমার ছোটো মেয়ের পাণিপ্রার্থীদের
মধ্যে তুমি অন্যতম। তুমি নিশ্চয়ই শুনেছ আমার ছোটো মেয়েকে সাম্রাজ্যের এক-তৃতীয়াংশ যৌতুক হিসাবে দেব বলে আমি পূর্বে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম। কিন্তু
এখন সে প্রতিশ্রুতি অর্থহীন। এখন সে পিতার স্নেহবঞ্চিত ঘৃণ্য এক তুচ্ছ নারী। এবার তুমি
বল, এই বঞ্চিতা, নিঃস্ব অভিশপ্তা
মেয়েকে তুমি কি আগের মতোই বিয়ে করতে আগ্রহী?
সব শোনার পর বুর্গান্ডির যুবরাজ অস্বীকার
করলেন কর্ডেলিয়াকে বিয়ে করতে। এবার ফ্রান্সের যুবরাজকে উদ্দেশ করে বললেন রাজা, প্রিয় যুবরাজ, এবার বল কর্ডেলিয়া সম্পর্কে তোমার
অভিমত কী?
ফ্রান্সের যুবরাজ বললেন, আমি আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি এই ভেবে কিছুক্ষণ আগে যে ছিল পিতার প্রাণস্বরূপ,
এমন কী কারণ ঘটল যে এই অল্প সময়ের মধ্যে সে বঞ্চিত হল পিতার স্নেহ
থেকে। সে যাই হোক, প্রকৃত ভালোবাসা স্বার্থহীন। কর্ডেলিয়ার
প্রতি আমার প্রেম যে কত নিবিড় তা প্রমাণ করার জন্য কর্ডেলিয়ার মতো প্রেম-ধন্যা, সততার পূজারি, সবার অবজ্ঞার পাত্র, নিঃস্ব অথচ সুন্দরী মেয়েকে
আমি ফ্রান্সের রানি এবং চিরসঙ্গিনী হিসাবে আনন্দের সাথে গ্রহণ করছি।
রাজা বললেন, বেশ, তাই হোক।
তারপর কর্ডেলিয়াকে আশীর্বাদ না করেই তিনি
চলে গেলেন রাজসভা ছেড়ে। আর তার সাথে
সাথে বেড়িয়ে গেল বুর্গান্ডির যুবরাজ, কর্নওয়াল, আলবেনি, গ্লচেস্টার ও তার অনুচরেরা।
প্রাসাদ ছেড়ে চলে যেতে যেতে কাঁদতে কাঁদতে
বললেন কর্ডেলিয়া, আমার দুর্ভাগ্য এই যে বাবা ভুল বুঝলেন আমায়। হে আমার বড়ো বোনেরা! তোমাদের প্রতিশ্রুতির উপরই
নির্ভর করছে বাবার ভবিষ্যৎ জীবন। আশা করি কর্তব্য পালনে তোমাদের কোনও ত্রুটি হবে না।
একথা বলেই তিনি চলে গেলেন ফ্রান্সের যুবরাজের
সাথে। তারা চলে যাবার পর গনেরিল চুপি চুপি বলল তার বোন রিগানকে, দ্যাখ, বুড়ো হয়ে আমাদের পিতা মানসিক দিক দিয়ে খুবই
দুর্বল আর অপ্রকৃতিস্থ হয়ে পড়েছেন। তাই তার পক্ষে সম্ভব হল প্রিয় কন্যার সাথে এরকম
ব্যবহার করার। এটা সত্যিই তার অবিবেচক মনের পরিচায়ক।
রিগান বলল, আর বলিস না! এটাই ওর চিরকেলে স্বভাব।
রিগানের কথা শুনে গনেরিল বলল, সেটা তো তাহলে আরও ভয়ের ব্যাপার। বয়স বেড়ে যাবার সাথে সাথে তার এই অভ্যেসটা
বেড়ে যাবে আর সেটা সহ্য করতে হবে আমাদের। আয়, আমরা দুজনে পরামর্শ
করি ভবিষ্যতে কী ভাবে এর হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
রিগান বলল, 'কথাটা তুমি ঠিকই বলেছ। খুব তাড়াতাড়িই পরামর্শটা করতে হবে আমাদের।'
অন্যদিকে গ্লাস্টারের প্রাসাদে সে সময়
দুভাইয়ের মধ্যে লড়াই চলছিল সম্পত্তি নিয়ে।
‘হে ঈশ্বর! সমাজে এমন নিয়ম কেন তুমি করেছ যে বংশের বড়ো ছেলেই সব কিছুরই মালিক হবে?
অথচ দেখ, এই বড়ো ভাইয়ের চেয়ে বয়সে আমি হয়তো
এক বছর কিংবা তার চেয়ে কম ছোটো, কিন্তু গুণে আর শক্তিতে কম
নই। তাহলে আমি কেন বঞ্চিত হব সম্পত্তি থেকে। যদি তোমার এই নিয়ম হয়, তাহলে জেনে রেখ....’ বলেই চুপ
করে যায় এডমন্ড। এরপর বড়ো ভাইয়ের উদ্দেশে বলল সে, বুদ্ধির জোরে আমিও
অধিকার করব তোমার সম্পত্তি। চিঠির মাধ্যমে কৌশলে পিতার স্নেহ থেকে দূরে সরিয়ে দেব তোমাকে
— এই আমার প্রতিজ্ঞা।
মনে মনে এডমন্ড যখন এরূপ মতলব আটছিল সে
সময় প্রবেশ করলেন তার বাবা গ্লচেস্টার।
ঘরে ঢুকেই এডমন্ডকে বললেন গ্লচেস্টার, ‘শুনতে পেলাম
রাজা নাকি নির্বাসন দণ্ড দিয়েছেন কেন্টকে? তিনি নাকি সমস্ত সম্পত্তি
এবং রাজক্ষমতা দু জামাইয়ের মধ্যে সমান ভাগে ভাগ করে দিয়ে নিজের জন্য নির্দিষ্ট করেছেন
সামান্য একটা বৃত্তি? ব্যাপার কী এডমন্ড? এত মনোযোগ দিয়ে কী পড়ছ তুমি?’
এডমন্ড বললেন, ‘ও কিছু নয়
বাবা,
ভাই এডগারের পাঠানো চিঠিটা পড়ছি।’
‘নিশ্চয়ই ওটা বিশেষ গোপনীয়’, বললেন গ্লচেস্টার, তা না হলে তুমি আমার কাছ থেকে
ওটা লুকোতে না। দেখি চিঠিটা?’
এডমন্ডের হাত থেকে সেই জাল চিঠিটা নিয়ে
পড়তে শুরু করলেন গ্লচেস্টার। পড়তে পড়তে এক সময় রাগে লাল হয়ে উঠল গ্লচেস্টারের মুখ।
চিঠিটাতে লেখা ছিল, ‘ভাই এডমন্ড, তাদের প্রতি আমাদের
শ্রদ্ধার সুযোগ নিয়ে বৃদ্ধরা আমাদের বঞ্চিত করে ধন-সম্পত্তি
থেকে, ব্যর্থ করে দেয় আমাদের জীবন-যৌবন। তাই এস আমরা দুজন বুড়ো বাবাকে মেরে ফেলে তার সমস্ত সম্পত্তি সমান
দু-ভাগে ভাগ করি আর সেই সাথে সার্থক করে তুলি আমাদের জীবন–ইতি এডগার।’
বাবার প্রশ্নের উত্তরে ইনিয়ে বিনিয়ে বলল
এডমন্ড,
আগে আমাদের আলাপ-আলোচনার মাঝে এডগার এরূপ
একটা ইঙ্গিত দিত বটে, তবে মনে হচ্ছে এ চিঠিটা তার লেখা নয়। কেননা জানলা গলিয়ে এ চিঠিটা কে যেন ভেতরে ফেলে গেছে।
গ্লচেস্টার বললেন, আমি বলছি চিঠিটা ওরই লেখা। এই এডগারকেই আমি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতাম। আমি
স্বপ্নেও ভাবিনি ও যে এত বড়ো শয়তান। যাও, ধরে নিয়ে এস সেই
বর্বরটাকে।
এডমন্ড বলল, আপনি অত উত্তেজিত হবেন না বাবা। আগে আড়াল থেকে আপনি নিজে সব কথা শুনুন,
তারপর না হয় তাকে শাস্তি দেবেন। নইলে তার প্রতি ঘোরতর অন্যায় করা
হবে বাবা!
‘ঠিক আছে, সেই ব্যবস্থাই কর,’ বললেন গ্লচেস্টার, ‘ওর আসল ইচ্ছেটা
জানার পর তুমি স্বর্গ মর্ত-পাতাল-যেখান থেকেই
হোক সেই শয়তানটাকে খুঁজে বের করে আন। পৃথিবীটা বড় পাপে ভরে গেছে। স্নেহের মধুর সম্পর্কগুলি
একে একে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। প্রেম, প্রীতি, শ্রদ্ধা- সব ক্ষেত্রেই আজ এত চক্রান্ত,
শঠতা আর প্রতারণা। বাবার বিরুদ্ধে ছেলে, ছেলের বিরুদ্ধে বাবার বিদ্রোহ, চক্রান্ত আজ ঘোরতর
অবস্থার মধ্যে দাঁড়িয়েছে। পূর্বে করা ভবিষ্যৎবাণী অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেছে আজ। কোনও
দাম নেই সততার! আমি বলছি এডমন্ড, নির্ভয়ে এগিয়ে যাও তুমি। যেভাবেই হোক, সেই শয়তানটাকে
খুঁজে বের কর তুমি। কঠিন শাস্তি দেব আমি তাকে। দায়িত্ব এড়াবার জন্য অধিকাংশ মানুষ
দোষারোপ করে তাদের ভাগ্যকে। কিন্তু চোর, জোচ্চোর, মাতাল, বদমাশ হবার পেছনে মানুষ নিজেই দায়ী।’
বলেই গ্লচেস্টার চলে গেলেন সেখান থেকে।
ঠিক তখনই এডমন্ড দেখতে পেল এডগার এদিকেই আসছে। ভীষণ অবাক হয়ে গেল সে।
এডগার বলল ছোটোভাইকে, কী হল এডমন্ড, তুমি এত গম্ভীর কেন?
নিরীহ মুখে বলল এডমন্ড, সে সব ভবিষ্যৎবাণীর কথাই আমি ভাবছি যাতে লেখা আছে পিতা-পুত্রের সম্পর্কছেদ, মৃত্যু। এছাড়াও আরও কত কথা।
যাক, সে সব কথা ছেড়ে দাও। বলতো বাবার সাথে শেষ দেখা তোমার
কবে হয়েছে? তার সাথে তোমার আচরণে কি কোনও অসন্তোষের ভাব প্রকাশ
পেয়েছিল? এসব আমি জানতে চাইছি কারণ বাবা তোমার উপর খুবই রেগে
আছেন। এর কারণ কী হতে পারে?
এডগার খুবই অবাক হল এডমন্ডের মুখে এ কথা
শুনে। তারপর বলল, ‘আমার এমন
ক্ষতি কে করল? গতকাল রাতেই তো আমি দু-ঘণ্টা ধরে
তার সাথে কথা বলেছি। কই, তখন তো তার মুখে কোনও রাগের চিহ্ন
দেখিনি!’
এডমন্ড বললেন, ‘এতে তুমি
ভয় পেও না। বাবা যতক্ষণ পর্যন্ত শান্ত না হন, তুমি আমার ঘরে এসে বিশ্রাম
করবে। তারপর তোমাকে আমি নিয়ে যাব তার কাছে। আমি ফিরে আসার পূর্বে যদি তোমার বাইরে যাবার
দরকার হয় তাহলে অস্ত্র নিয়ে যেও সাথে। তোমার ভালোর জন্যই বলছি এ কথা। নাও, আর দেরি করো না। আমার ঘরের চাবিটা নাও আর এ জায়গা ছেড়ে শীঘ্র পালাও।’
এডগার আটকে পড়ল মায়াজালে।
সে চলে যাবার পর মনে মনে খুব খুশি হয়ে
বলতে লাগল এডমন্ড, আমার বুদ্ধির জোর বেশি আর তোমার আছে শুধু বোকা
সততা। সেই সততার সুযোগ নিয়েই আমায় হস্তগত করতে হচ্ছে তোমার সম্পত্তি। তুমি একটা বোকা,
নির্বোধ আর তাই ঈশ্বরের কাছে তুমি করুণার পাত্র ছাড়া আর কিছু নও।
রাজার বড়ো মেয়ে তার প্রাসাদে সে সময় ব্যস্ত ছিলেন প্রধান অনুচরদের সাথে
আলোচনায়। দুঃখের সাথে
বললেন গনেরিল, ‘অসওয়াল্ড! একথা কি সত্য যে তার বিদূষককে অপমান করার
জন্য বাবা মেরেছেন আমার অনুচরকে?’
ঘাড় নেড়ে সায় দিলেন অসওয়াল্ড। তখন গনেরিল
বলল, ‘সত্যিই অসহ্য
হয়ে উঠছে বাবার এই নিত্যনতুন অত্যাচার। আর তার নাইটরাও হয়েছে তেমনি অসভ্য, বর্বর। বুঝলে অসওয়াল্ড, এবার থেকে তুমি আর অন্য
চরেরা সব সময় তার সাথে এমন ভাব-ভঙ্গি করবে যাতে তিনি রেগে
গিয়ে বোনের বাড়ি চলে যান। আর আমিও নিষ্কৃতি পাব তাতে। অসুস্থতার ভান করে আমিও কথা
বলব না তার সাথে। বোনকে চিঠি দিয়ে জানিয়ে দেব সে যেন বাবার সাথে আমার মতোই ব্যবহার
করে। আর সহ্য হচ্ছে না সব বিষয়ে তার অকারণ তিরস্কার। যে করেই হোক বন্ধ করতে হবে বাচ্চাদের
মতো বুড়ো বাবার এরূপ আচরণ ঐ শোন, দূর থেকে আওয়াজ আসছে তার আগমনের বাদ্যধ্বনির। এবার তোমরা যাও, আমার আদেশ অনুযায়ী তার সাথে
ভালো বা খারাপ ব্যবহার করবে।
- - - - - - - -
- - - - -
‘তুমি কে? কী তোমার পেশা?’ সামনে দাঁড়ান
ছদ্মবেশী ডিউক অব কেন্টকে প্রশ্ন করলেন রাজা লিয়ার স্বয়ং।।
কেন্ট বললেন, ‘মহারাজ, আমার পোশাকই বহন করছে আমার কর্মদক্ষতার পরিচয়। আমি খুব দরিদ্র তবে কখনও বিশ্বাসের অমর্যাদা করি না। আমি সৎ আর
জ্ঞানী লোকদের পছন্দ করি। সামান্য কারণে যুদ্ধ করি না আর মদও খাই না।’
কেন্টের কথা শুনে করুণায় ভরে গেল রাজার মন। কেন্টকে তিনি বললেন,
তুমি সত্যিই গরিব। কী চাও তুমি আমার কাছে?
‘আমি অনুপ্রাণিত হয়েছি
আপনার মুখে প্রভুত্বের দীপ্তি দেখে’, বললেন কেন্ট,
‘আমি চাই আপনার অধীনে কাজ করতে।’
রাজা জানতে চাইলেন, কি কাজ করতে পারবে তুমি?
কেন্ট উত্তর দিলেন, আমি জানি দরকারি কথার গোপনীয়তা রক্ষা করতে, দ্রুত
ঘোড়ায় চড়তে। এছাড়া সাধারণ মানুষের অন্যান্য গুণেরও অধিকারী আমি। আমি কঠোর পরিশ্রম করতে
পেছপা নই, বয়সও সহজে কাবু করতে পারে না আমায়।
কেন্টের কথা শুনে রাজা বললেন, আমার ভৃত্য হিসেবে আমি তোমায় মনোনীত করলাম।
Next Part
No comments:
Post a Comment