Contrast between King Priam and Zeus |
হোমারের ইলিয়াড মহাকাব্যে প্রায়াম ট্রয়ের
রাজা,
আর দেবতাদের প্রধান জিউস স্বর্গের রাজা। মর্ত্যরাজা প্রায়ামের সাথে
তার পার্থক্য শুধু এটুকুই যে, রাজা প্রায়াম মরণশীল মানব আর
জিউস অমর। কিন্তু ট্রয়ের যুদ্ধে এ দুজন রাজার চরিত্র একইরূপে প্রতিভাত হয়। তাঁদের মনমানসিকতা
ও কর্মকাণ্ডে কে অমর আর কে মরণশীল এটা আলাদা করা মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়। কারণ দুজনেরই
সন্তানেরা জড়িত হয়ে পড়ে ট্রয়যুদ্ধে। দুজনই তাদের সন্তানদের প্রতি চরম দুর্বলতা
প্রকাশ করেন। এ ক্ষেত্রে অমর দেবতা জিউস তার অমরত্ব ভুলে সহজেই মরণশীল মর্তমানবের
পর্যায়ে নেমে যান। এবং নিজ সন্তানদের প্রতি সহানুভূতি আর সহায়তা প্রদান করতে গিয়ে
সাধারণ মর্তমানবের মতোই আচরণ করতে থাকেন। রাজা প্রায়াম মরণশীল। তিনিও ভোগ করেন
অপরিসীম দুঃখবেদনা ট্রয়যুদ্ধের কারণে। হোমার এখানে দেখাতে চেয়েছেন যে, জিউস তো অমর, কিন্তু প্রায়াম তো মরণশীল। জিউসের
মধ্যে বেদনাবোধ জাগ্রত হলেও তাঁর তো কোনো ক্ষয় নেই কিন্তু রাজা প্রায়াম তো আর মর্ত্যে
চিরকাল থাকবেন না। তার সমাপ্তি ঘটবেই, তবুও জিউসের মাঝে
মরণশীল মানবের মতোই আচরণ লক্ষ করা যায়। তিনি মরণশীল মানবের মতোই নানা প্রতারণা আর
চাতুরালির আশ্রয় গ্রহণ করেন নিজের দিকটাকে জয়ী করার জন্য। শেষে অবশ্য হাল ছেড়ে দেন;
গ্রিস আর ট্রয় দু’পক্ষের মাঝেই ছেড়ে
দেন যুদ্ধের ফলাফলের ভার। এদিকে রাজা প্রায়ামের মাঝে আমরা দেবসুলভ একটি চরিত্রের
বিকাশ লক্ষ করি যা দেবতা জিউসের মাঝে লক্ষ করা যায় না। দেবরাজ জিউস তার পুত্রের
প্রতি কতটা দুর্বল এটা লক্ষ করা যায় ট্রয়যুদ্ধে যখন তাঁর পুত্র সার্পেন
প্যাট্রোক্লাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামে। দেবরাজ জিউস তখন তাঁর পত্নী হেরাকে ডেকে
চিন্তাকুল মনে বলেন, “সেকি? আমার। প্রিয়
সার্পেড়ন আজ একজন মর্তমানবের হাতে মরতে বসেছে, আমি কি তাকে
যুদ্ধক্ষেত্র হতে তুলে এনে লাইসিয়ায় পাঠিয়ে দেব, নাকি
প্যাট্রোক্লাসের হাতে তাকে মরতে দেব, কোনোটাই ঠিক করতে পারছি
না।’ ইিলিয়াড-১৬, ৪৩৬-৪৩৭]
এখানে জিউসের খেদোক্তি একজন
মর্তমানবের খেদোক্তিকেও ছাড়িয়ে যায়। দেবী হেরার সাথে পরামর্শ করে জিউস ট্রয়যুদ্ধে
যোগদানকারী তার সন্তানদের সর্বদা রক্ষা করার জন্য নানা রকম সাময়িক বিপর্যয় সৃষ্টি
করতে থাকেন। অন্যদিকে রাজা প্রায়াম তার পুত্রদের অকপটে ছেড়ে দিয়েছেন যুদ্ধক্ষেত্রে
নিজ নগরীর সম্মান রক্ষার্থে। পুত্রদের
ভাগ্যবিপর্যয় এবং তাদের মৃত্যুতে প্রায়ামকে কোনো চাতুরালি কিংবা প্রতারণার আশ্রয়
গ্রহণ করতে দেখা যায় না। রাজা প্রায়াম
অপরিসীম দুঃখবেদনা ভোগ করেছেন কিন্তু জিউসের মতো পুত্রদের রক্ষার্থে কোনো
প্রতারণার আশ্রয় গ্রহণ করেননি। রাজা প্রায়াম আর জিউসকে পাশাপাশি দাঁড় করিয়ে বিচার
করলে দেবরাজ জিউসের দেবত্বসুলভ রূপটি একেবারে দূর হয়ে যায়। তাকে তখন একজন সাধারণ
মর্তমানব বিশেষ করে একজন সংকীর্ণমনা আত্মসুখ অন্বেষী একজন মানব বলেই প্রতীয়মান হয়।
এদিকে রাজা প্রায়াম একজন মর্তমানব হয়েও ট্রয়যুদ্ধে দেবসুলভ মহিমার প্রকাশ ঘটান। যে
হেলেনকে অপহরণ করে আনার জন্য এই যুদ্ধ, যে প্যারিস তাকে হরণ করে
এনেছেন, সেই পরিত্যক্ত প্যারিসকে রাজা প্রায়াম বুকে জড়িয়ে ধরেন,
গ্রহণ করে নেন হেলেনকে। আর হেলেন ও প্যারিসকে রক্ষা করার জন্য তিনি
যেকোনো ত্যাগ স্বীকার করতে সদা প্রস্তুত থাকেন। এখানেও আমরা রাজা প্রায়ামের ভেতরের
মহান দিকটির প্রকাশ লক্ষ করি। রাজা প্রায়াম একে একে তাঁর সব প্রিয় সন্তানকে
যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠান প্যারিস ও হেলেনকে রক্ষা করার জন্য। এক কথায়, রাজা প্রায়াম এর আচরণে মনে হয় সে কোন অমর দেবতা আর জিউস এর এই সকল নিকৃষ্ট
কাজ গুলো দেখে মনে হয় সে কোন মরণশীল মানব । ইলিয়াড মহাকাব্যে জিউস নন, রাজা প্রায়ামই যেন অমর দেবতা হিসেবে বিরাজমান।
No comments:
Post a Comment