৫ম পর্ব শুরুঃ
সিজারের মৃতদেহ নিয়ে অ্যান্টনি চলে
এলেন রোম শহরের মাঝখানে একটা খোলামেলা প্রশস্ত
জায়গায়, যেখানে কারও ভাষণ
শুনতে বা নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করতে সমবেত হতেন রোমের নাগরিকেরা। সিজারের মৃতদেহ সেখানে নিয়ে
যাবার জন্যে -- রোমের সাধারণ মানুষ, যারা ভালোবাসতেন অ্যান্টনিকে, তারা দলে দলে এসে সেখানে ভিড় জমাল। ভিড় জমছে দেখে জনতার সামনে এগিয়ে এসে তার ভাষণ শুরু করলেন ব্রুটাস:
“হে
রোমের অধিবাসীবৃন্দ! তোমাদের মনে স্বাভাবিকভাবে যে প্রশ্ন জেগেছে আজ তারই জবাব দিতে এসেছি আমি। তোমরা সবাই জান আমি
ছিলাম সিজারের অন্তরঙ্গ বন্ধু- এ বন্ধুত্ব দীর্ঘদিন ধরে গড়ে উঠেছিল আমাদের মধ্যে। সিজারকে আমি যতটা ভালোবাসতাম, তোমরা কেউ ততটা
বাসতে না। সিজার ছিলেন একজন খাঁটি রোমান, মহান বীর- তাই আমি তাকে ভালোবাসি, শ্রদ্ধা করি। কিন্তু দিনে দিনে তার উচ্চাশা বেড়ে উঠছিল। নিজে
রাজা হবার জন্য সমস্ত ক্ষমতা কুক্ষিগত
করতে শুরু করছিলেন তিনি। কিন্তু তোমরা জেনে রাখ সিজার আমার যতই প্রিয় হোন না কেন, আমার কাছে সবচেয়ে
প্রিয় আমার জন্মভূমি- রোম। এই
রোম থেকে বহুদিন আগে রাজতন্ত্রকে হঠিয়ে
প্রতিষ্ঠা করেছি গণতন্ত্রের। সেই গণতান্ত্রিক দেশের স্বাধীন নাগরিক তোমরা। হে আমার বন্ধু রোমানরা! আজ সিজার বেঁচে
থাকলে তিনি হতেন রাজা আর স্বাধীনতা হারিয়ে তোমরা হতে তার প্রজা। সেই স্বাধীনতা রক্ষার জন্যই আমরা বাধ্য হয়েছি সিজারকে হত্যা করতে। এবার
তোমরাই বিচার কর, বল আমরা ঠিক কাজ করেছি কিনা?
সেখানে উপস্থিত রোমের জনতা সমবেত ভাবে বলে উঠল, “স্বাধীনতা রক্ষার জন্য তোমরা ঠিক কাজই করেছ ব্রুটাস”।
ব্রুটাস বললেন, “তোমাদের অভিমত যদি এই হয় তবে তার সাথে আমি
একমত। এবার সবাই মন দিয়ে শোন আমার কথা। আমার মতোই মার্ক অ্যান্টনিও ছিলেন
সিজারের এক অভিন্ন- হৃদয় বন্ধু।
সিজারকে সমাধি দেবার আগে তিনি তার সম্বন্ধে তোমাদের কিছু বলতে চান। আমি চাই সিজারের প্রতি সম্মান জানাবার জন্য
তোমরা সবাই মন দিয়ে তার কথা শুনবে”।
ব্রুটাসের বক্তব্য শেষ হবার পর মঞ্চে
এলেন অ্যান্টনি। সমবেত জনতাকে উদ্দেশ করে তিনি বললেন, “হে আমার
রোমান বন্ধুরা! মাননীয় ব্রুটাস আমায় সুযোগ দিয়েছেন সিজার সম্পর্কে তোমাদের কাছে কিছু বলার। আশা করি তোমরা সবাই
মন দিয়ে শুনবে আমার কথা”।
সে সময় উপস্থিত জনতার মধ্য থেকে
একদল লোক জোর গলায় চেঁচিয়ে বলে উঠল, ‘আপনার যা খুশি
তা বলতে পারেন। তবে আগেই জানিয়ে রাখছি ব্রুটাসের
নিন্দা বা সমালোচনা সহ্য করব না আমরা। আমরা মনে করি সিজারকে হত্যা করে ব্রুটাস
ও তার সঙ্গীরা ঠিক কাজই করেছেন’।
“সে তো নিশ্চয়ই”, সায় দিয়ে বললেন অ্যান্টনি, “ব্রুটাস একজন মহৎ ব্যক্তি, রোমের সবাই জানে সে
কথা। কোনও অন্যায় কাজ করতে
পারেন না তিনি। আজ আমি এখানে এসেছি সিজারকে সমাধি দিতে, তার প্রশংসা করতে
নয়। কিছুক্ষণ আগে ব্রুটাস বলেছেন সিজার খুব উচ্চাভিলাষী ছিলেন। ব্রুটাসের
অভিযোগ সত্যি হলে বলতেই হবে খুব অন্যায় করেছেন সিজার। আমরা জানি প্রতিটি মানুষই কিছু না কিছু উচ্চাশাকে আকড়ে ধরেই বেঁচে
থাকার চেষ্টা করে। সেই সাথে আমরা এও
জানি উচ্চাশা জিনিসটাই খারাপ। তবে সিজারের
উচ্চাশার কোনও প্রমাণ কিন্তু কেউ পায়নি।
এই তো সেদিনের কথা তোমরা সবাই জান, আমি নিজে সিজারের মাথায়
মুকুট পরিয়ে দিতে গিয়েছিলাম, কিন্তু তিনি নেননি। পরপর তিনবার আমার হাত ঠেলে সরিয়ে দিয়েছেন তিনি। এবার তোমরাই বল, এর দ্বারা কী প্রমাণ হয় সিজার সত্যিই উচ্চাভিলাষী ছিলেন?”
জাদুমন্ত্রের মতো কাজ হল অ্যান্টনির
কথায়। ব্রুটাসের কথা শুনে
যেমন মোহ্গ্রস্ত হয়েছিল জনতা, অ্যান্টনির কথায় সে
মোহের ঘোর কেটে গেল। তারা ভেবে দেখল, সত্যিই তো, যে সিজার বার বার
রাজমুকুট প্রত্যাখ্যান করেছেন, তিনি কি উচ্চাভিলাষী হতে পারেন?
তাহলে কিছুক্ষণ
আগে ব্রুটাস তাদের কী বুঝিয়েছেন? স্বভাবতই এ প্রশ্ন জাগল তাদের। জনতার
চোখ- মুখ আর হাবভাব দেখে
অ্যান্টনি বুঝতে পারলেন এবার সফল হতে চলেছে তার উদ্দেশ্য। তিনি এমনভাবে সিজারের গুণাবলির বর্ণনা দিতে
লাগলেন যা শুনে কিছুক্ষণ আগে হত্যাকারীদের প্রতি যে সামান্য শ্রদ্ধা-ভক্তি জন্মেছিল জনতার মনে, এবার তা কর্পুরের মতো উবে গেল। ব্রুটাস, ক্যাসিয়াস, কাসকা ইত্যাদি যারা নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছিল সিজারকে, তাদের
ঘরবাড়ি পুড়িয়ে ছাই করে দিয়ে
প্রতিশোধস্পৃহা জেগে উঠল জনতার মনে।
আরও একধাপ এগিয়ে গিয়ে অ্যান্টনি
জনতাকে পড়ে শোনালেন সিজারের উইল। সেই উইলে
সিজার তার নিজস্ব বাগান ও অন্যান্য সম্পত্তির কথা ছিল। সেই বাগানে মানুষ আনন্দে ঘুরে বেড়াতে পারবে। তাছাড়া রোমের সাধারণ
মানুষকে ভালোবেসে তিনি তাদের প্রত্যেককে নগদ
পঁচাত্তর লিরা করে নগদ অর্থ দান করে গেছেন। উইলটা জনতাকে পড়ে শোনাবার পর অ্যান্টনি বললেন, “এমনই
মহান মানুষ ছিলেন সিজার। এবার আপনারাই বিচার করে বলুন তিনি উচ্চাভিলাষী ছিলেন কিনা!”
এবার সীমাহীন ক্রোধে ক্ষিপ্ত হয়ে
উঠল জনতা। তারা চেঁচিয়ে বলতে লাগল, “ওরে বিশ্বাসঘাতক শয়তানের
দল! তোদের কাউকে রেহাই দেব না আমরা। পুড়িয়ে দেব ব্রুটাসের বাড়ি। সিজার হত্যার
প্রতিশোধ নেব আমরা। হত্যাকারীদের বধ করে, তাদের বাড়ি-ঘর পুড়িয়ে
ছাই করে দেবার সংকল্প নিয়ে
দল বেঁধে এগুতে লাগল জনতা। ব্রুটাস আর ক্যাসিয়াস যখন জানতে পারলেন তাদের ধরতে আসছে, তখন তারা যে যার
বাড়ি-ঘর ছেড়ে সীমান্ত পেরিয়ে বহুদূরে পালিয়ে গেলেন। তাদের যে সব সহযোগী সিজার হত্যার সাথে জড়িত ছিল, জনতা তাদের খুঁজে বের করে
বিনা বিচারে মেরে ফেলল, পুড়িয়ে ছাই করে দিল তাদের ঘর-বাড়ি। এবার ব্রুটাস আর ক্যাসিয়াস বুঝতে
পারলেন দেশে ফিরে গেলে জনতার হাতে মৃত্যু হবে তাদেরও। আর যদিও বা জনতার
হাত থেকে ছাড়া পাওয়া যায়, তাহলেও মার্ক অ্যান্টনির হাত থেকে
রক্ষা নেই তাদের।
অ্যান্টনির হাত থেকে বাচতে হলে
লড়াইয়ের প্রয়োজন। তাই তারা প্রচুর টাকাকড়ি খরচ করে লড়াইয়ের জন্য অস্ত্রশস্ত্র এবং সৈন্যর জোগাড় করতে লাগলেন। এরই মধ্যে রোমে এসে পৌঁছালেন সিজারের
ভাইপো অক্টাভিয়াস। তিনি বয়সে
অ্যান্টনির চেয়ে ছোটো হলেও ভালো যোদ্ধা এবং যথেষ্ট রাজনৈতিক জ্ঞানসম্পন্ন লোক। তাছাড়া
রোমের এক শাসক মার্কাস এমিল লেপিডাসকেও বন্ধু
হিসেবে পেলেন তিনি। তারা উভয়ে যোগ দিলেন আান্টনির সাথে। অ্যান্টনি, অক্টাভিয়াসকে জানালেন
যে যুদ্ধের জন্য তৈরি হচ্ছেন ব্রুটাস ও ক্যাসিয়াস। এবার তারাও তৈরি হতে লাগলেন শক্রর সাথে মোকাবিলার জন্য।
সিজারকে হত্যার প্রতিশোধ নেবার
উদ্দেশ্যে তার সেনাবাহিনীর কয়েকজন অভিজ্ঞ সেনানীও যোগ দিলেন মার্ক অ্যান্টনির সাথে। সামান্য কয়েকদিন বাদেই যুদ্ধ
বেধে গেল দু-পক্ষের মধ্যে। যুদ্ধ
চলাকালীন ব্রুটাসের পত্বী
সোফিয়া আত্মহত্যা করলেন বিষ খেয়ে। পত্বীর শোকে মুহ্যমান হয়ে গেলেন ব্রুটাস। ইতিমধ্যে বিবেকের দংশনে অস্থির হয়ে গেছেন তিনি ক্যাসিয়াসের
বুদ্ধিতে সিজার হত্যার
চক্রান্তে যোগ দিয়ে তিনি যে মোটেই ভালো কাজ করেননি, সে কথা এতদিনে উপলব্ধি হল তার। যুদ্ধ চলাকালীন মাঝে মাঝেই তার সাথে ঝগড়া ও কথা-কাটাকাটি
হতে লাগল ক্যাসিয়াসের।
কিন্তু অন্যায়ের সাহায্য নিতে রাজি নন ব্রুটাস। অথচ অর্থ এবং সৈন্য সংগ্রহের জন্য যে কোনও নীচ কাজ করতে সবসময় তৈরি
ক্যাসিয়াস। একদিন তাদের বিবাদ চরমে উঠে গেল।
বুদ্ধিমান ক্যাসিয়াস নিজেকে সামলে নিলেন, নইলে হয়ত সেদিন উভয়ের
মাঝে রক্তারক্তি কাণ্ড ঘটে যেতো। সেদিন রাতে তাবুর
ভিতর আবির্ভূত হল সিজারের আত্মা (দুঃস্বপ্ন)। যাবার আগে সেই আত্মা বলে গেলেন, আবার দেখা হবে ফিলিগির যুদ্ধক্ষেত্রে
।
সিজারের আত্মা দেখা দিলেও ফিলিগির যুদ্ধে শক্রসৈন্যের হাতে পরাস্ত হলেন ব্রুটাস ও ক্যাসিয়াস। ধরা পড়লে অ্যান্টনি তাদের প্রাণদণ্ড দেবেন। তাই
ধরা পড়ার আগেই প্রাণদণ্ডের বিকল্প
হিসাবে সম্মানজনক মৃত্যুর আশ্রয় নেওয়াই শ্রেয় বলে মনে করলেন তারা। যে ছুরি একদিন সিজারের বুকে বসিয়েছিলেন ক্যাসিয়াস, সেই ছুরি বিশ্বস্ত ভৃত্য জিন্ডারাসের হাতে দিয়ে তাকে আদেশ দিলেন সে যেন ছুরিটা তার বুকে
বসিয়ে দেয়। চোখের জল ফেলতে ফেলতে মালিকের আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করল জিন্ডারাস।
এবার ব্রুটাসও তার তলোয়ার ভৃত্য
স্ট্যাটোর হাতে গুঁজে দিয়ে
নিজেই ঝাপিয়ে পড়লেন সে তলোয়ারের উপর। গোটা তলোয়ারটাই ঢুকে গেল তার হৃৎপিণ্ডে।
“সিজারের আত্মার শান্তি হোক” -- শুধু এইটুকু বলে রক্তাক্ত দেহে মাটিতে
লুটিয়ে পড়লেন ব্রুটাস। ইশারায় ব্রুটাসের
মৃতদেহকে দেখিয়ে যুবক অক্টাভিয়াসকে বললেন অ্যান্টনি, “সব দিক দিয়েই উনি ছিলেন একজন খাঁটি রোমান। সিজার হত্যার চক্রাস্তকারীদের
একজন হলেও তিনি একজন মহান লোক --
প্রয়াত সিজারের বিশিষ্ট বন্ধুদের অন্যতম। ঈর্ধার বশবর্তী হয়ে অন্যান্য সব চক্রান্তকারীরা হত্যা করেছে সিজারকে।
একমাত্র উনিই দেশ ও দশের মঙ্গলের কথা ভেবে যোগ দিয়েছিলেন তাদের সাথে।
-----End-----
Many many thanks dear
ReplyDeleteThank you so much for translation
ReplyDelete