পর্ব ৩ এর পর থেকেঃ
এদিকে আর্তেমিদোরাস নামে এক গ্রিক
অধ্যাপক কোনওভাবে জানতে পেরেছিলেন সিজারকে হত্যার চক্রান্তের কথা। তিনি সিজারকে উদ্দেশ্য করে চক্রান্তকারীদের সবার নাম জানিয়ে একট চিঠি লিখলেন। যেদিক দিয়ে সিজার সেনেটে
ঢুকবেন তিনি তার একধারে চিঠিটা হাতে নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন। যে ব্যাক্তিটি ১৫ মার্চের ব্যাপারে সিজারকে সাবধান করে দিয়েছিলেন তিনিও এসে দাঁড়ালেন অধ্যাপকের পাশ। তাকে দেখে সিজার বললেন, “আরে, ১৫ মার্চ তো এসে গেছে। আজই তো সেই দিন!
সিজারের প্রবল আত্মবিশ্বাস দেখে সে বললেন, “হ্যা সিজার! আজই ১৫ মার্চ। দিনটা সবে শুরু হয়েছে, শেষ হতে এখনও বাকি।” তাকে পাত্তা না দিয়ে
সিজার এগিয়ে যাবেন এমন সময় অধ্যাপক
আর্তেমিদোরাস তার লেখা চিঠিটা সিজারের হাতে দিয়ে বললেন, মহামান্য সিজার!
দয়া করে আমার আবেদনটা পড়ে দেখুন। সিজারের বিরুদ্ধে চক্রান্তকারীদের অন্যতম মেটেলাস ট্রেবনিয়াসও তার আবেদনপত্রটি
এগিয়ে দিলেন সিজারের দিকে। সেটি পড়ে দেখার জন্য ডিসিয়াস অনুরোধ জানালেন সিজারকে। এইসব দেখে ঘাবড়ে
গিয়ে গ্রিক অধ্যাপক বললেন, “মাননীয় সিজার! আমার আবেদনের সাথে জড়িয়ে
আছে আপনার স্বার্থ। অনুগ্রহ করে ওটা আগে
পড়ুন”
সিজার বললেন, “না, তা হয় না। আপনার
আবেদনের সাথে যদি আমার ব্যক্তিগত বিষয় জড়িয়ে থাকে, তাহলে সেটা সবশেষে পড়া
হবে।”
ব্যস্ত হয়ে অধ্যাপক বললেন, “এ নিয়ে
আপনি আর দেরি করবেন না সিজার। দয়া করে এটি এখনই পড়ে ফেলুন”
“লোকটার মস্তিষ্কের সুস্থতা নিয়ে
আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে”, বললেন সিজার। তারপর অধ্যাপককে উদ্দেশ করে তিনি বললেন, “আমি
আপনাকেই বলছি, যদি আপনার কোনও আবেদন থাকে, তাহলে সেটা রাস্তায় নয়, সিনেটে এসে আমায় দেবেন”।
সবাইকে নিয়ে সেনেটে ঢুকে তার
নির্দিষ্ট আসনে বসলেন সিজার। তার বিশ্বস্ত বন্ধু মার্ক অ্যান্টনি কাছেই দাড়িয়েছিলেন।
কৌশলে তাকে সেখান থেকে সরিয়ে দিলেন ক্যাসিয়াসের বন্ধু ট্রেবোনিয়াস।
এবার চক্রান্তকারীরা এগিয়ে গেল
তাদের পরিকল্পিত পথে। প্রথমে সিনেটর মেটেলাস হাতজোড় করে বললেন, “মাননীয় সিজার!
অনুগ্রহ করে আপনি আমার নির্বাসিত ভাইকে দেশে
ফেরার অনুমতি দিন”।
“তা হয়
না মেটেলাস”, বললেন সিজার, “তোমার ভাই অপরাধী। বিচারে তার অপরাধের উপযুক্ত সাজা পেয়েছে সে। সে সাজা মওকুফ করার পেছনে কোনও যুক্তি নেই আর তা তুলে নেবার অধিকারও আমার নেই। আর যাই হোক, দেশের আইন-কানুন ছেলেখেলার বিষয়বস্তু নয়”।
ব্রুটাস
এগিয়ে এসে সিজারের হাত চুম্বন করে বললেন, “আপনি
যদি মেটেলাসের ভাইকে মুক্তি দেন, তাহলে খুবই ভালো হয়”। সিজার স্বপ্নেও ভাবেননি ব্রুটাসের মতো একজন ন্যায়পরায়ণ লোক এরূপ অন্যায় অনুরোধ করতে পারে।
ব্রুটাসের পরপর একই আবেদন জানালেন ক্যাসিয়াস।
কিন্তু তাকে ওই একই জবাব দিলেন সিজার
। তিনি জানালেন কাউকে অনুনয় যেমন তার পক্ষে সম্ভব নয়, তেমনি অন্যের অনুরোধ তিনি গ্রাহ্যের
মধ্যেও আনবেন না। তাতে যদি তারা বলেন যে পাইলিয়াসকে নির্বাসন দণ্ড দেওয়া অন্যায় হয়েছে, তাহলেও সে নির্বাসন দণ্ড রদ করবেন না তিনি।
সিজারের কথা শুনে সমস্বরে বলে উঠল
সবাই,
‘হে সিজার! আপনি মহান’। কিন্তু তাতে একটুও নরম হলেন না সিজার। এবার চক্রাত্তকারীদের মধ্যে থেকে বেরিয়ে এল ক্যাসকা।
চিন্তা-ভাবনা না করে কোমর থেকে ধারালো ছোরা বের করে আমুল বসিয়ে দিল সিজারের কাধে। অবাক হয়ে আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন সিজার। রক্তে ভেসে যাচ্ছে পরনের সাদা পোশাক। আশ্চর্য হয়ে দেখলেন সকালে যারা তার বাড়িতে গিয়ে
অভিনন্দন জানিয়ে এসেছে, এখন তাদেরই সবার
হাতে ছুরি, চোখে-মুখে ফুটে উঠেছে প্রচণ্ড ঘৃণা, আক্রোশ আর প্রতিশোধ - স্পৃহা।
এরপর ক্যাসিয়াস, মেটেলাস, সিন্না,
ডিসিয়াস, ট্রেবোনিয়াস, লাইগোরিয়াস – সবাই পরপর এগিয়ে এসে ছুরি বসিয়ে দিল সিজারের বুকে।
টলতে টলতে সিজার এগিয়ে গেলেন বন্ধু ব্রুটাসের দিকে। আগে থেকে ব্রুটাসের হাতে ছিল ছোরা। কিন্তু সে মুহূর্তে ব্রুটাসের বিবেক কেন যেন মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। তিনি কোনো মতে নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে চোখ বুজে ছোরা বসিয়ে
দিলেন সিজারের বুকে।
আর্তনাদের সুরে সিজার বললেন, “ব্রুটাস! শেষে তুমিও?” আর কোনো
কথা বেরুল না সিজারের মুখ থেকে।
রক্তাক্ত দেহে তিনি লুটিয়ে পড়লেন সিনেটের
শক্ত মেঝেতে।
এবার সমবেতভাবে বলে উঠল
চক্রান্তকারীরা, “রক্ষা পেয়েছে রোমের স্বাধীনতা। মৃত্যু হয়েছে অত্যাচারী শাসকের। যাও! বাইরে গিয়ে তোমরা
জোরালো গলায় এ কথা বল”।
সিনেট থেকে বের হয়ে চক্রান্তকারীরা
ছড়িয়ে পড়ল চারিদিকে। এবার তাদের ব্যাখ্যা করার পালা কেন তারা বাধ্য হয়েছে রোমের জনপ্রিয়
শাসক জুলিয়াস সিজারকে হত্যা করতে। রোমের স্বাধীনতাকে বাচাবার
জন্যই যে তারা একাজ করেছেন সে কথা বুঝিয়ে বলতে হবে সবাইকে।
সিজারকে হত্যা করার আগেই তার বন্ধু
মার্ক অ্যান্টনিকে সিজারের পাশ থেকে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন ট্রেবোনিয়াস। অ্যান্টনি যখন জানতে পারলেন যে সিজারকে খুন করা হয়েছে। তিনি ভয় পেলেন এই ভেবে যে সিজারের বন্ধু হিসাবে
হয়তো চক্রান্তকারীরা এবার তাকেও হত্যা করবে। তিনি সেখান থেকে পালিয়ে সোজা চলে গেলেন
নিজের বাড়িতে।
অ্যান্টনি
বেশ বুদ্ধিমান লোক। তিনি ভেবে-চিন্তে লোক পাঠালেন ব্রুটাসের কাছে। তার লোক ব্রুটাসকে এটাই বোঝাল যে এখন থেকে ব্রুটাস ও তার সাথীদের নির্দেশ মতোই চলবেন অ্যান্টনি।
সিজারের একজন বিশ্বস্ত বন্ধু ছিলেন অ্যান্টনি। সে বেঁচে থাকলে হয়তো ঝামেলা বাধাতে পারে এ কথাই ব্রুটাসকে বোঝাতে চাইলেন তার
সঙ্গীরা। তাদের অভিমত সিজারের মতো অ্যান্টনিকেও
মেরে ফেলা হোক।
তাদের কথায় আপত্তি জানিয়ে ব্রুটাস বললেন, “না, তা সম্ভব নয়। সিজারের জীবিতকালে হয়তো অ্যান্টনি
তার বিশ্বস্ত বন্ধু ছিল। কিন্তু এখন সে তো একজন সাধারণ লোক। তাকে ভয় করার কী আছে! অহেতুক রক্তপাত ঘটালে খেপে
যেতে পারে রোমের জনসাধারণ”। এরপর অ্যান্টনি প্রেরিত লোকের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তুমি আন্টনিকে বলে দিও যে তিনি স্বচ্ছন্দে দেখা করতে পারেন ব্রুটাসের সাথে। ব্রুটাস ও তার সঙ্গীদের তরফ থেকে বিপদের কোনও আশঙ্কা নেই তার।
ব্রুটাস ও তার সঙ্গীদের মনোভাব অবগত
হবার পর আর দেরি না করে অ্যান্টনি গিয়ে দেখা করলেন ব্রুটাসের সাথে। তাকে বন্ধুর মতো খাতির করে বসালেন ব্রুটাস। সিজার প্রসঙ্গ উঠতেই তিনি অ্যান্টনিকে
বললেন কেন সিজারকে হত্যা করার প্রয়োজন হয়েছিল সে কথা তিনি সময় মতো বুঝিয়ে দেবেন তাকে।
সব কথা শোনার পর ব্রুটাসকে অনুরোধ জানিয়ে অ্যান্টনি বললেন, “সিজারের মৃতদেহটা আমার
হাতে দিন। আমি সেটা সমাধিস্থ করতে চাই। কিন্তু তার আগে সিজারের কীর্তির বিষয়ে কিছু বলতে চাই জনসাধারণের কাছে। আমার মনে
হয় তাতে সিজারের আত্মার প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা
প্রদর্শন করা হবে”।
এতক্ষণ ধরে ব্রুটাসের পাশে বসে মন দিয়ে উভয়ের কথা শুনছিলেন ক্যাসিয়াস। অ্যান্টনির প্রস্তাব
শুনে তিনি ব্রুটাসকে আড়ালে ডেকে
নিয়ে গিয়ে বললেন, “অ্যান্টনি যদি বলে
যে সিজারের সমাধি দেবার আগে
জনতার সামনে সে কিছু বলবে, তুমি কিন্তু তাতে রাজি হয়ো না”।
পালটা প্রশ্ন করলেন ব্রুটাস, “কেন তাতে ভয় পাবার কি আছে? ক্যাসিয়াস যে অ্যান্টনিকে কেন ভয় পাচ্ছে তা বোধগম্য হল না তার”।
অ্যান্টনি
যাতে শুনতে না পায় এ ভাবে বললেন ক্যাসিয়াস, “ব্রুটাস!
তুমি এখনও চিনতে পারনি রোমের
জনসাধারণকে। তারা এখনও ভালোবাসে সিজারকে। বলা যায় না, হয়তো ত্যান্টনির কথা
শুনে উত্তেজিত হয়ে উঠতে পারে।,
একই স্বরে জানালেন ব্রুটাস, “না ক্যাসিয়াস, সে সুযোগ আমি দেব না অ্যান্টনিকে।
আগে আমি জনসাধারণকে
বোঝাব কেন হত্যা করা হয়েছে সিজারকে, তারপর আমার অনুমতি নিয়ে অ্যান্টনির যা বলার তা সে বলবে। তবে আপত্তিজনক বা উত্তেজনাকর কিছু
বললে সাথে সাথে তার প্রতিবাদ করব
আমি”।
ক্যাসিয়াস বললেন, “বুঝতে পারছি না কী হবে। আমার কিন্তু মোটেও ভালো ঠেকছে না। কাজটা
বোধহয় ঠিক হল না”।
আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে অ্যান্টনিকে
বললেন ব্রুটাস, “সমাধি দেবার জন্য এবার তুমি নিয়ে যেতে পার সিজারের মৃতদেহ। সিজারের
গুণাবলি সম্পর্কে জনতাকে কিছু বলার থাকলে তাও বলতে পার তুমি। তবে আমার বক্তব্য শেষ হবার পরই তোমার যা
বলার তা বলবে”, অ্যান্টনি
বললেন,
“বেশ, তাই হবে। এর চেয়ে বেশি কিছু চাই না আমি”।
মৃতদেহ নিয়ে যাবার জন্য” বলে ক্যাসিয়াসকে সাথে নিয়ে চলে
গেলেন ব্রুটাস।
পরের পর্ব(শেষ পর্ব)
No comments:
Post a Comment