অ্যান্টনির
সাথে কথা বলতে বলতে সিজার অন্যদিকে চলে গেলেন তার সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে। ক্যাসিয়াসের ঘনিষ্ঠ সঙ্গীদের একজন ক্যাসকা।
তার কাছ থেকে ব্রুটাস শুনতে পেলেন
উপস্থিত জনতার সামনে অ্যান্টনি
একটা রাজমুকুট পরিয়ে দিতে গিয়েছিল সিজারের মাথায়। কিন্তু পরপর তিনবারই সিজার অ্যান্টনির হাতটা ঠেলে সরিয়ে দেয়। তা দেখে সবার ধারণা হয় সিজার
রাজমুকুট পরতে চান না অর্থাৎ
রাজা হবার কোনও বাসনা নেই তার। এসব দেখে-শুনে ক্যাসকার মনে হয়েছে জনতার কাছে মহৎ সাজার জন্যই
অনিচ্ছাসত্তেও এ রাজমুকুট ঠেলে সরিয়ে দিয়েছেন সিজার। নইলে রাজমুকুট পরার সাধ তার খুবই ছিল। ক্যাসিয়াসও
সায় দিল সে কথায়।
সে রাতে ক্যাসিয়াস তার মতাবলম্বী
আরও কয়েকজনকে বাড়িতে ডেকে এনে গোপনে নানারূপ আলোচনা করলেন। এভাবেই শুরু হল সিজারকে উচ্ছেদ করার ষড়যন্ত্র।
বহুদিন হল রাজাকে উৎখাত করে গণতন্ত্র
প্রতিষ্ঠা করেছে দেশের মানুষ, কায়েম
হয়েছে জনগণের শাসন। একের পর এক
যুদ্ধে জিতে আর দেশ জয় করে উচ্চাভিলাষী হয়ে
উঠেছে সিজার। রাজমুকুট মাথায় না পড়লেও সিজার যে রাজা হতে চান সে বিষয়ে
দ্বিমত নেই। কিন্তু রোমের শান্তিকামী জনগণ কিছুতেই রাজতন্ত্রকে ফিরিয়ে আনতে রাজি নয়।
রাতের খাওয়া-দাওয়ার পর সবাইকে ব্রুটাসের বাড়িতে নিয়ে এলেন ক্যাসিয়াস। রোমের সবাই জানে ক্যাসিয়াস লোকটা মোটেই সুবিধের
নয়। তাকে চিনতে ভুল হয়নি
সিজারের। কিন্তু ব্রুটাস এক বুদ্ধিজীবী লোক, ব্যক্তিগতভাবে তাকে যথেষ্ট ভালোবাসেন সিজার। এ ধরনের লোককে দলে ভেড়াতে না পারলে সিজারকে হঠাবার
চক্রান্ত মোটেই সফল হবে না। কাজেই সবার সম্মুখে রোমের স্বাধীনতা রক্ষায় ব্রুটাসের সাহায্য চাইলেন। প্রয়োজন হলে দেশের জন্য মৃত্যুবরণ
করতে হবে__ বেশ নাটকীয় ঢং-এ সবার
সামনে একথাটা বললেন ক্যাসিয়াস।
ব্রুটাস সবাইকে জানালেন রাতের
অন্ধকারে কে বা কারা তার ঘরের খোলা জানালা দিয়ে প্রচুর চিঠি ফেলে রেখে গেছে। সব চিঠিরই বক্তব্য মোটামুটি একই
রকম- রোমের মানুষ প্রচণ্ড শ্রদ্ধা
করে ব্রুটাসকে। সেই সাথে সিজারের উচ্চাভিলাষের
উল্লেখও রয়েছে সে সব চিঠিতে। ব্রুটাস
জানালেন দেশের মানুষ যে তাকে এত ভালোবাসে, শ্রদ্ধা করে তা তিনি
জানতেন না।
ব্রুটাসের কথা শুনে মনে মনে
আত্মপ্রসাদের হাসি হাসলেন ক্যাসিয়াস, কারণ বুদ্ধিটা তারই।
নানা লোককে দিয়ে চিঠিগুলো লিখিয়ে রাতের
অন্ধকারে নিজেই সেগুলো ফেলে দিয়ে এসেছিলেন ব্রুটাসের ঘরে। চিঠিগুলো
পড়েই পালটে গেছে ব্রুটাসের মন। সিজারকে
উৎখাত করার কথা দানা বাধতে শুরু
হয়েছে তার মনে।
এবার চালে বাজিমাত করলেন ক্যাসিয়াস - সফল হল তার উদ্দেশ্য। স্পষ্ট ভাষায় ব্রুটাস জানিয়ে
দিলেন সিজারকে হাটাবার চক্রান্তে তিনিও সামিল আছেন এবং সে ব্যাপারে যথাসাধ্য সাহায্য ও সহযোগিতা করবেন তিনি, কারণ সিজারের চেয়ে
দেশ তার কাছে অনেক বেশি দামি। নিজের
উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করতে সিজার যদি রোমের মানুষের স্বাধীনতা হরণ করতে চান, তাহলে তাকে হটিয়ে দিতে পিছপা হবেন না তিনি।
অনেক রাত ধরে সবাই আলোচনা করলেন
কীভাবে হটানো যায় সিজারকে। এ বিষয়ে সবাই একমত হলেন যে সিজারকে হটাতে হলে তাকে মেরে ফেলা ছাড়া
অন্য কোনও পথ নেই। কিন্তু সমস্ত
সৈন্যরা সিজারের অনুগত, দেশের প্রধান সেনাপতি তিনি। দেশের মানুষদের অধিকাংশই তার সমর্থক।
স্বার্থের সংঘাত বেধে গেলে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠবে, কেউ তা রোধ করতে পারবেনা।
একবার যুদ্ধ বেধে গেলে ক্যাসিয়াস ও
তার সহযোগীরা সবাই কচুকাটা হবে সিজারের সেনাবাহিনীর হাতে। কাজেই যুদ্ধ বেঁধে যাবার আগেই হত্যা করতে হবে সিজারকে।
এ ছাড়া অন্য কোনও পথ নেই।
ধীরে ধীরে এগিয়ে এল সেই ১৫ মার্চ।
রোমের সিনেটের সদস্যরা সে দিন এক বিশেষ অধিবেশন ডেকেছেন আর তাতে যোগ দেবার জন্য
আমন্ত্রণ জানান হয়েছে সিজারকে। চারদিকে কানাঘুঁষো
শোনা যাচ্ছে সিনেটের সদস্যরা নাকি
সিজারের মাথায় রাজমুকুট পরিয়ে রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে চান দেশে। সাথে সাথে এও শোনা যাচ্ছে জনতার
কাছে মহান হবার জন্য তিনবার রাজমুকুট
ফিরিয়ে দিয়েছেন সিজার। কিন্তু এবার সিনেটররা তার মাথায় রাজমুকুট পরিয়ে দিলে সানন্দে তিনি তা গ্রহণ করবেন। এদিকে
ক্যাসিয়াস-ব্রুটাস চক্র কিন্তু
চুপচাপ বসে নেই। তারা সংকল্প করেছে
সেনেটের ভেতর মাথায় রাজমুকুট পরার আগেই তারা হত্যা করবে সিজারকে।
ঘটনার আগের দিন রাতে ঘুমের ঘোরে
বারবার দুঃস্বপ্ন দেখেছেন সিজারের স্ত্রী ক্যালপূর্ণিয়া। এ দিন শুধু সেনেটে যাওয়া নয়, রাজপ্রাসাদ থেকে
বেরুতেও নিষেধ করেছেন স্বামীকে। কিন্তু
সেই বীর জুলিয়াস সিজার, যার জীবনের প্রায় অর্ধেক কেটে গেছে
পৃথিবীর নানা প্রান্তে যুদ্ধ
করতে করতে - সে ভয় পায় না
দুঃস্বপ্নে। তার মতে ভীরুরা বার বার মরে, আর বীর একবারই
মরে। কিন্তু স্ত্রীর কথায় কিছুটা বিচলিত হলেন তিনি। তিনি স্থির করলেন আজ সিনেটে যাবেন
না, প্রাসাদেই কাটাবেন ক্যালপুর্ণিয়ার
সাথে,
ষড়যন্ত্রকারীদের কাছে যথাসময়ে খবর পৌছে গেল আমন্ত্রিত হওয়া সত্ত্বেও আজ
সেনেটে যাবেন না সিজার। ষড়যন্ত্রকারীরা দেখল সিজার সেনেটে না গেলে তাদের এতদিনের মতলবটা ভেস্তে যাবে। ডিসিয়াস ছিল ষড়যন্ত্রকারীদের একজন। ক্যাসিয়াস তাকেই দায়িত্ব দিলেন ভুলিয়ে-ভালিয়ে
সিজারকে সেনেটে নিয়ে আসার।
ক্যাসিয়াসের নির্দেশে সিজারের
প্রাসাদে গেল ডিসিয়াস। সিজার তাকে
বললেন গতরাত ঘুমের মাঝে
দুঃস্বপ্ন দেখেছে তার স্ত্রী। তাই তিনি স্থির করেছেন আজ সিনেটে যাবেন না। ডিসিয়াস
বললেন,
“আপনার স্ত্রী কি দুঃস্বপ্ন দেখেছেন তা কি
আমায় শোনাবেন?”
সিজার বললেন, “নিশ্চয়ই শোনাব। কাল রাতে আমার স্ত্রী
স্বপ্ন দেখেছে যে আমার প্রতিমূর্তির মুখ
থেকে ঝলকে ঝলকে রক্ত বেরুচ্ছে এবং রোমের বিশিষ্ট নাগরিকরা হাসিমুখে সেই রক্ত দিয়ে তাদের হাত ধুয়ে নিচ্ছেন। স্ত্রীর মতে এই
স্বপ্ন আমার জীবন সংকটের ইঙ্গিত দিচ্ছে। তাই স্থির করেছি আজ আর বের হব না।”
ডিসিয়াস
বলল, “মাননীয় সিজার! আপনার স্ত্রীর প্রতি
যথাযোগ্য শ্রদ্ধা নিয়েই বলছি স্বপ্নের
যে ব্যাখ্যা উনি দিয়েছেন তা ঠিক নয়। বরঞ্চ উনি যে স্বপ্ন দেখেছেন তা সব দিক
দিয়েই সৌভাগ্যের ইঙ্গিত
দিচ্ছে। আপনার প্রতিমূর্তির মুখ দিয়ে
ক্ষণে ক্ষণে রক্ত বেরুচ্ছে আর সেই রক্তে
বিশিষ্ট রোমান নাগরিকরা হাত ধুচ্ছেন-এর অর্থ নানা দেশের রক্ত সংগ্রহ করে রোমের অতীত গৌরব ফিরিয়ে আনবেন আপনি। আর এ কাজে রোমের বিশিষ্ট নাগরিকরা সাহায্য করবেন
আপনাকে । আপনি কেন এই সুলক্ষণযুক্ত স্বপ্নকে দুঃস্বপ্ন বলে ধরে নিচ্ছেন মাননীয় সিজার?”
“তাহলে তুমি আমার স্ত্রীর স্বপ্নের এই ব্যাখ্যা করছ?” বললেন সিজার, “আসলে এভাবে আমি ব্যাপারটা ভেবে দেখিনি।
ডিসিয়াস বললেন, “এবার আমার কথা শুনুন মহামান্য সিজার। আজ
সেনেটেররা আপনার মাথায়
রাজমুকুট পরাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আপনি না গেলে হয়তো তাদের সিদ্ধান্তের পরিবর্তনও হতে পারে। ভূলে যাবেন না, আপনার স্ত্রী দুঃস্বপ্ন
দেখেছেন বলে আপনি সিনেটে যাবেন না, তাহলে সিনেটরদের
কাছে আপনার মান-মর্যাদা থাকবে কি? আপনি তাদের কাছে কাপুরুষের পর্যায়ে পড়ে যাবেন”।
মনে মনে স্ত্রীর কথা ভেবে বললেন
সিজার,
“কালপুর্ণিয়া! দুঃস্বপ্ন দেখে যে ভয় তুমি
পেয়েছ তা নিছক ভিত্তিহীন - এতে কোনও সন্দেহ নেই আমার। ওহে কে আছ! আমার সিনেটে যাবার পোশাকগুলো
এনে দাও”।
ডিসিয়াস চলে যাবার আগেই একে একে
সেখানে এলেন ক্যাসকা, সিন্না, মেটেলাস,
লিগারিয়াস, ট্রেবনিয়াস
এবং ক্যাবলিয়াস।
তাদের সবাইকে দেখে অবাক হয়ে বললেন
সিজার,
“কী ব্যাপার! তোমরা সবাই এসে হাজির হয়েছ আমার বাড়িতে? তোমাদের সবাইকে জানাই সুপ্রভাত।” ঠিক সে সময় এসে হাজির মার্ক অ্যান্টনি। তাকে
দেখে হেসে বললেন সিজার, “কী
ব্যাপার অ্যান্টনি! অনেক রাত অবধি ফুর্তি করেও এই সাত সকালে এসেছ তুমি?
সিজারকে হাসিমুখে অভিবাদন জানিয়ে অ্যান্টনি বললেন, “সুপ্রভাত
সিজার।”
এক এক করে সবার দিকে তাকিয়ে বললেন
সিজার,
“এসো, ভেতরে এসো। কিছুক্ষন পরে আমরা সবাই একসাথে সেনেটে যাব”।
৪র্থ পর্ব
৪র্থ পর্ব
No comments:
Post a Comment