এরিস্টটলের পোয়েটিসঃ কাব্যরচনা কলা
সূচনা ও ১ম অধ্যায়ের টিকাসমূহঃ
সূচনা
১। মহাকাব্য বা Epic হচ্ছে
দীর্ঘ
ও
বিস্তৃত
কবিতা
বিশেষ।
সাধারণতঃ
দেশ
কিংবা
সংস্কৃতির
বীরত্ব
গাঁথা
এবং
ঘটনাক্রমের
বিস্তৃত
বিবরণ
এতে
পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে
তুলে
ধরা
হয়।
সুপ্রাচীনকালে
মুখে
মুখে
প্রচলিত
কবিতাসমগ্রও
মহাকাব্যের
মর্যাদা
পেয়েছে।
২। Tragedy আদী-মধ্য-অন্ত সমন্বিত কোন গুরুগম্ভীর নাট্যকাহিনীতে কোন অসাধারন গুনসম্পন্ন নায়কের নিয়তির প্রভাবে বা চরিত্রের ত্রুটির জন্যে তাঁর ধ্বংস বা পরাজয় ঘটে যা দর্শকদের মনে করুণা ও ভয়ের সৃষ্টি করে এবং পরিশেষে ক্যাথারসিস বা পরিষ্কারন ঘটে তাকে ট্রাজেডি বলে।
৩। Comedy উৎসবের
রঙ্গরস,
হাসি-তামাশা
ও
হাস্য-পরিহাসমুখর
অভিনয়
থেকে
সৃষ্টি
হয়েছিল কমেডি বা
কোমোদিয়া-
আনন্দোজ্জ্বল,
পরিহাসদীপ্ত
নাটক।
কোমোদিয়া
শব্দের
অর্থ
‘আনন্দিত
অধিবাসীদের
গান’।
৪। Dithyrambic poetry ডিথির্যাম্ব
কবিতাঃ
গ্রীক
পুরাণে
উল্লিখিত
দেবতা
ডায়োনিসাসের স্তুতি বা বন্দনামুলক এক ধরনের কবিতা। আগে সম্ভবতঃ একক কষ্ঠেই গাওয়া হত। খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীর দিকে এই স্তুতিগান সমবেত
সঙ্গীতে
পরিণত
হয়।
তখন
এ-সঙ্গীত
বাঁশীবাদন ও নৃত্যসহকারে পরিবেশিত হত। ছাগলের চামড়া আবৃত হয়ে পঞ্চাশজন গ্রীক
যুবক/পুরুষ ডায়োনিসাসের বেদীর চারদিকে চক্রাকারে নৃত্য
করতে
করতে
এ-সঙ্গীত
পরিবেশন
করত।
স্বভাবতই ডায়োনিসাস সম্পর্কিত কোন পৌরাণিক কাহিনী আশ্রয়েই এ-জাতীয় সঙ্গীত বা কবিতা রচিত হত। ইতালীর পুরাণে ডায়োনিসাস ব্যাকাস রূপে উল্লিখিত হয়েছেন। তিনি প্রকৃতির উৎপাদিকা শক্তিরও প্রতীক।
৫। Imitation অনুকরণ বলতে
আরিস্টটল,
সম্ভবত, মানুষের
জীবন
বিশেষ
উদ্দেশ্য
বা
ইচ্ছা
প্রণোদিতভাবে চিত্রায়নের কথা বুঝাতে চেয়েছেন।
টিকাসমূহঃ ২য় অধ্যায়-কাব্যিক অনুকরণের মাধ্যম
১। Prose গদ্য
হলো
মানুষের
কথ্য
ভাষার
লেখ্যরূপ।
এর
বিপরীত
হলো
পদ্য
বা
কাব্য। গদ্যের
প্রাথমিক
ব্যবহার
চিঠিপত্র
লেখায়,
দলিল-দস্তাবেজ
প্রণয়নে
এবং
ধর্মীয়
গ্রন্থাদি
রচনায়।
২। Poem কবিতা, কাব্য
বা
পদ্য
হচ্ছে
শব্দের
ছন্দোময়
বিন্যাস
যা
একজন
কবির
আবেগোত্থিত অনুভূতি,
উপলব্ধি
ও
চিন্তাকে
সংক্ষেপে
এবং
উপমা-উৎপ্রেক্ষা-চিত্রকল্পের
সাহায্যে
উদ্ভাসিত
করে
এবং
শব্দের
ছন্দায়িত
ব্যবহারে
সুমধুর
শ্রুতিযোগ্যতা
যুক্ত
করে।
৩। Literature সাহিত্য শব্দটির গ্রীক প্রতিশব্দ নেই। সমস্ত রকম সাহিত্যকর্ম বোঝাবার জন্য গ্রীকদের কোন শব্দ ছিলনা। সম্ভবতঃ আরিস্টটল এখানে সাহিত্য সম্বন্ধেই ইঙ্গিত দিয়েছেন।
৪। সফ্রোন (Sophron) একজন প্রাচীন গ্রীক নাট্যকার। তিনি খ্রীষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে বর্তমান ছিলেন। সাধারণ জীবন ও চরিতাশ্রয়ী প্রসন্ন হাস্যরস-সমৃদ্ধ তাঁর নাটকগুলো গদ্যাকারেই রচিত
হয়েছিল। তাঁর গদ্যবন্ধে রচিত নাট্যদৃশ্য থেকেই নাকি প্লেটো তাঁর সংলাপাদি রচনার সূত্র পেয়েছিলেন। পরবর্তী কবি
থিওক্রিটাস-রচিত পঞ্চদশ রাখালিয়া গীতিটি সোফ্রোন রচিত কোন নাট্যদৃশ্যেরই পদ্যরূপ বলে মনে করা হয়।
৫। জেনার্কাস (Xenarchus) জেনার্কাসও সোফ্রোনের ন্যায় গদ্যবন্ধে নাটক রচনা করেছিলেন বলে জানা যায়। তাঁর পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত করে কিছু জানা যায় না। অনেকেই তাঁকে সফ্রোনের পুত্র বলে মনে করেন।
৬। সক্রেটিস (Socrates) প্রাচীন গ্রীসের এক সত্যান্বেষী মনীষী দার্শনিক। তিনি খ্রীষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে বর্তমান ছিলেন। একজন লোকশিক্ষক ও চিন্তানায়ক হিসেবে তিনি সমসাময়িক গ্রীসের তরুণ-সমাজের উপর প্রভূত প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। তাঁর শিষ্যদের মধ্যে প্লেটো ও জেনোফেন সমধিক প্রসিদ্ধ ছিলেন। তাঁর দর্শনের মূল কথা হলঃ জ্ঞান সকল
সৎ
ও
মহৎ
প্রেরণার
উৎস
আর
অজ্ঞতা
সকল
কুসংস্কার ও অশুভ প্রবৃত্তির জনক। অতএব জ্ঞানার্জনই মনুষ্য জীবনের প্রধান লক্ষ্য হওয়া উচিত। আশ্চর্যের বিষয়, সত্যের পথ থেকে বিচ্যুত হতে অস্বীকৃতি জানানোর জন্য এই মনীষীকে হেমলক বিষপানে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছিল। তিনি কোন গ্রন্থ রচনা করেছিলেন বলে জানা যায় না। তবে তিনি শিক্ষকতাব্যপদেশে শিষ্যদের সাথে নানা প্রসঙ্গে যে সব মূল্যবান কথা বলতেন তার অনেকটাই গদ্য-সংলাপের আকারে রক্ষিত হয়েছে।
৭। ইয়াম্বিক
ছন্দ Iambic Trimeters গ্রীক ও ল্যাটিন ভাষায় যে ছন্দে প্রতি পর্বে একটি হ্রস্ব অক্ষরের
পর
একটি দীর্ঘ
অক্ষরের সমাবেশ
ঘটে,
তাকে
ইয়াম্বিক ছন্দ বলে। ইংরেজীতে একটি প্রস্বরহীন ধ্বনির (Syllable) পর
একটি
প্রস্বরযুক্ত অক্ষরের সমাবেশ ঘটলে ইয়াম্বিক ছন্দ
সৃষ্টি
হল
বলা
হয়। এ ছন্দে ব্যঙ্গকবিতা রচিত হতো বলে একে ব্যঙ্গোক্তির ছন্দও বলা হয় ।
৮। এলিজিয়াক ছন্দঃ Elegiac Couplets গ্রীক এলিজিয়াক ছন্দ মহাকাব্যিক ছয় মাত্রার ছন্দেরই বিবর্তিত একটি রূপ। গীতিকাব্যের স্বভাব-সঙ্গত
করে
তোলার
জন্য
প্রতি ৬ মাত্রার পংক্তির
পরে
একটি
করে
তথাকথিত
‘পঞ্চমাত্রিক’ পংক্তির সমাবেশ ঘটিয়ে এলিজিয়াক ছন্দ গড়ে তোলা হয়েছে। এই পঞ্চমাত্রিক পংক্তির মধ্যে সুস্পষ্ট একটি ভাগ আছে। এই ভাগটি ছন্দ-সংকেত জ্ঞাপক চিহ্নের সাহায্যে এভাবে নির্দেশ করা যায়ঃ- vy-y-/-yY -vv- ।
৯। হোমার (Homer) বিশ্ববিখ্যাত দুই মহাকাব্য ইলিয়াড ও ওডিসির স্রষ্টা মহাকবি হোমার খ্রীষ্টপূর্ব নবম শতাব্দীতে বর্তমান ছিলেন বলে অনুমান করা হয়। তাঁর ব্যক্তিজীবনের পরিচয় আজও প্রায় অজ্ঞাত রয়ে গিয়েছে। পণ্ডিতগণের ধারণা তিনি সম্ভবত ৮৫০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে অথবা ট্রোজান যুদ্ধের চারশত বছর পরে জন্মগ্রহণ করেন। শোনা যায়, হোমার
জন্মান্ধ
ছিলেন।
গ্রীক
বলে
পরিচিত
হলেও
হোমারের
পূর্বপুরুষরা এশিয়াবাসী ছিলেন। হোমারের জন্মস্থান নিয়েও বিতর্ক রয়েছে। স্মার্ণা,
গিয়োজ,
কলোফন, সালামিস, রোডস,
অ্যানগস এবং এথেন্স এই সাতটি নগর-রাষ্ট্রের প্রত্যেকটিই হোমরের জন্মস্থান বলে দাবী করে। কথিত হয় যে, হোমার স্বহন্তে কোন কাব্য লেখেন নি। তিনি স্থান হতে স্থানে ঘুরে কাব্যকাহিনী আবৃত্তি করতেন এবং তাঁর কণ্ঠে প্রাচীন কাহিনীর ঘটনাবলী প্রাণবন্তভাবে মূর্ত হয়ে উঠত। ঐ কালজয়ী গাথাই পুরুষানুক্রমে লোক-মুখে গীত হয়ে পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। হোমারের কাব্যের উপাদান ট্রয়নগরের কাহিনী ও সংশ্লিষ্ট ঘটনাবলী। শ্রুতি ও
স্মৃতি আশ্রিত এই কাহিনীতে ঐতিহাসিক উপাদানও রয়েছে। তবে শুধু কাব্য হিসেবেও এদের এমন একটি সত্যগ্রাহী রূপ আছে যে তা চিরকাল অম্লান হযে থাকবে। প্লেটোর মতে হোমার গ্রীসদেশের শিক্ষার উৎস ও সর্বকালের এক মহাকবি ।
১০। এম্পিডোক্লিস (Empedocles) সিসিলির অধিবাসী এম্পিডোক্লিস ছিলেন এক বিখ্যাত দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক। খ্রীষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীর
প্রথমার্ধে তিনি বর্তমান ছিলেন। তিনি ছয় মাত্রিক ছন্দে পদার্থবিদ্যা ও ভৈষজ্যবিদ্যা বিষয়ক বহু নিবন্ধ রচনা করেছিলেন। আরিস্টটল এম্পিডোক্লিসকে কবি হিসেবে স্বীকৃতি দেন নি। কারণ তার মতে এম্পিডোক্লিসের প্রতিভা ছিল মূলতঃ বৈজ্ঞানিক। তিনি ছন্দোবন্ধে গ্রন্থ রচনা করলেও নির্মাণক্ষম প্রতিভার পরিচয় দিতে পারেন নি। কিন্তু আরিস্টটলের এই মত সম্পর্কে সংশয় প্রকাশের যথেষ্ট অবকাশ রয়েছে। এম্পিডোক্লিসের কবিকর্ম নিতান্ত বহিরঙ্গমূলক নয়। তাঁর প্রকৃতিবিষয়ক একটি কবিতায় আমরা পাই মহাজাগতিক নাটকের ব্যাপ্তি। অসম্পূর্ণ হলেও সমালোচকদের মতে, কবিতাটিতে এক চমৎকারী কল্পনাশক্তি পরিস্ফুট হয়েছে। তাঁর আর একটি কবিতার বিষয় হচ্ছে নরক থেকে স্বর্গ পর্যন্ত মানবাত্মার তীর্থযাত্রা। কবিতাটির মধ্যে
সেই তীর্থযাত্রার বেদনা ও আনন্দ অপরূপ ভাষা ও ছন্দ-মাধুর্যে ফুটে উঠেছে। মনে হয় জীবনবাস্তববাদী আরিস্টটলের কাছে এম্পিডোক্লিসের কাব্যে মহাজাগতিক পটভূমি অলীক বলে মনে হয়েছিল বলেই, তিনি এম্পিডোক্লিসের কবি-প্রতিভাকে অস্বীকার করেছিলেন।
১১। চেইরিমোন (Chaeremon) প্রাচীন গ্রীসের এথেন্সের অধিবাসী। চেইরিমোন ছিলেন একজন প্রসিদ্ধ
নাট্যকার
ও
কবি।
তিনি
খ্রীষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে বর্তমান ছিলেন। তিনি ট্রাজেডি এবং
কমেডি
উভয়বিধ
নাটকই
রচনা
করেছিলেন। তাঁর রচনাবলীর মধ্যে ‘থার্সাইটিসের হত্যাকারী একিলিস’ নামক নাটক এবং সেন্টর নামক কাব্য প্রসিদ্ধ।
১২। নোমিক কবিতাঃ Nomic Poetry নোমিক কবিতা বা নোমগীতি ডিথির্যাম্ব গোত্রীয় এক ধরনের দেবস্তুতি- মূলক
গীতি। কোন গ্রীক
দেবতার
সম্মানার্থে বীণা অথবা বাঁশী সহযোগে এ-সঙ্গীত হয়। সাধারণতঃ দেবতা এপলোর সম্মানেই এ স্তুতিগীতি
রচিত
ও
গীত
হত। এ-সব
রচনায় থাকত
গঠনের
ও
ভাবের
গাষ্টীর্য ও সুষমা।
fantastic
ReplyDelete