অন্যান্য লিঙ্ক সমূহঃ
১। ইংরেজিতে মূল টেক্সট ২। ১ম অঙ্কের অনুবাদ ৩। ২য় অঙ্কের অনুবাদ ৪। ৩য় অঙ্কের অনুবাদ ৫। ৪র্থ অঙ্কের অনুবাদ ৬। ড. ফস্টাসের সমস্ত টিকাসমূহ বাংলায়। ৭। ক্রিস্টোফার মার্লোর জীবন
The tragical history of Dr. Faustus by Christopher Marlowe - Bengali Translation - ড. ফস্টাস - ক্রিস্টোফার মার্লো - সম্পূর্ন বাংলা অনুবাদ
ডক্টর ফস্টাস
পঞ্চম অঙ্ক
প্রথম দৃশ্য
[ফস্টাসের গৃহের একটি কক্ষ - ওয়াগনারের প্রবেশ]
ওয়াগনারঃ মনে হয়, আমার প্রভু অল্পদিনের মধ্যেই মারা যাবেন কারণ তিনি তার
সমস্ত। বিষয় আশয় আমায় দান করেছেন। তা সত্ত্বেও আমার ধারণা মৃত্যু এত নিকটবর্তী হয়ে
থাকলে তিনি ছাত্রদের নিয়ে পেটপূজায় মত্ত থাকতেন না। এই মুহুর্তেও তিনি ঐ কাজটিই করছেন।
আমি ওয়াগনার এমন কাণ্ড জীবনেও দেখিনি। দেখুন, তারা ফিরে আসছে। সম্ভবতঃ ভোজসভা শেষ হয়েছে।
[দুতিনজন পণ্ডিতসহ ফস্টাস এবং
মেফিস্টোফিলিসের প্রবেশ]
প্রথম পণ্ডিতঃ আচার্য ডক্টর ফস্টাস, পৃথিবীর মাঝে কোন্ রমণী সুন্দরী শ্রেষ্ঠা সে
প্রসঙ্গে আমরা আলাপ করেছি। আলোচনায় এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলাম, যে গ্রীসের হেলেন৫১
সর্বযুগের সর্বাধিক প্রশংসিত রমণী। মাস্টার ডক্টর আপনি যদি কৃপা করে সেই অতুলনীয়া গ্রীক নারীকে, বিশ্ববাসী যার রূপের
বন্দনা করে থাকে, আমাদের সামনে হাজির করেন তবে আপনার কাছে বিশেষ কৃতজ্ঞ থাকব।
ফস্টাসঃ ভদ্র মহোদয়গণ আমি জানি আপনাদের বন্ধুত্বের মাঝে কোন খাদ নেই। শুভাকাঙ্খীদের ন্যায্য অনুরোধ উপেক্ষা করার
অভ্যাস ফস্টাসের নেই। যেদিন রাজপুত্র প্যারিস গ্রীসের সেই অতুলনীয়া সুন্দরীকে নিয়ে সাগর পাড়ি দিয়ে লুটের মাল
সমেত সমৃদ্ধ নগরী দার্দানিয়ায়৫২ প্রবেশ করেছিলেন, সেদিন হেলেনের যে
রূপমাধুরী ও ঐশ্বর্য ছিল, আজও অবিকল সেভাবেই তাকে দেখতে পাবেন । কথা বললে বিপদ
ঘটতে পারে অতএব নীরব হয়ে অপেক্ষা করুন।
[সঙ্গীতধ্বনি হতে থাকে এবং হেলেন মঞ্চের উপর দিয়ে হেঁটে যায়]
দ্বিতীয় পণ্ডিতঃ যে নারীর রূপে সারা বিশ্ব মুগ্ধ হয়েছে, তার যথার্থ
প্রশংসা করার সামর্থ্য আমার নেই।
তৃতীয় পণ্ডিতঃ এমন একজন সুন্দরীর অপহরণে কুদ্ধ গ্রীকরা যদি দশবর্ষ ব্যাপী
যুদ্ধে লিপ্ত থাকে তাতে অবাক হবার কিছু নেই। হেলেনের রূপের সাথে কারোর তুলনাই চলে না।
প্রথম পণ্ডিতঃ প্রকৃতির গৌরবময় সৃষ্টি ও সেরা সৌন্দর্য্যের একমাত্র
প্রতিমূর্তিকে আমরা দেখলাম। চলুন, যাওয়া যাক। এমন চমৎকার একটা কাজের জন্য আমরা ফস্টাসের
উত্তরোত্তর সুখী ও মঙ্গলময় জীবন কামনা করি।
ফস্টাসঃ সুভদ্রজন, বিদায়। আপনাদের জন্য আমার একই কামনা। [পণ্ডিতদের প্রস্থান]
[এক বৃদ্ধের প্রবেশ]
বৃদ্ধঃ আহা ডক্টর ফস্টাস, আমি যদি তোমাকে জীবনের সঠিক পথে চালনা করতে পারতাম তবে সেই পথ
তোমাকে অনন্ত শান্তির দিকে এগিয়ে নিত। হৃদয় নিংড়ে কাদো, রক্ত ঝরুক। মিশে যাক
রক্তস্রোত আর অশ্রধারা। অতি জঘন্য ও হীন কাজের জন্য ঝরাও অনুশোচনার অশ্রধারা।
পাপাচারের দুর্গন্ধে তোমার অন্তর পুতিগন্ধময় হয়ে উঠেছে। এত সাংঘাতিক সব পাপকর্ম করেছ যে
পরিত্রাতা ঈশ্বরের করুণা বিনা তা মোচন হবে না। তাঁর পবিত্র শোণিতধারা তোমার সব অপরাধ, সব
পাপকে বিধৌত করতে পারে।
ফস্টাসঃ তুমি কোথায় অবস্থান করছ, ফস্টাস? হতভাগ্য, এ তুমি কি করেছ? তুমি। অভিশপ্ত,
অভিসম্পাতগ্রস্ত। তাই হতাশায় ভুগে ভুগেই মর। নরক গর্জাচ্ছে ও যথার্থভাবেই
তোমায় আহবান জানিয়ে বলছে, ‘এসো ফস্টাস, এসো তোমার জীবনের
অন্তিম মুহুর্ত সমাগত’। ফস্টাস এখন ঐ আহবানেই সাড়া দিতে অগ্রসর হবে।
[মেফিস্টোফিলিস ফস্টাসের হাতে একটি
ছোরা দেয়]
বৃদ্ধঃ আঃ প্রিয় ফস্টাস, থাম। নিজেকে ছুরিকাহত করা থেকে নিবৃত্ত হও । তোমার মাথার উপর এক
ফেরেশতাকে উড়ে বেড়াতে
দেখছি। হাতে তার অমূল্য করুণার আধার। তিনি তোমার আত্মাকে সেই করুণাধারায় সিক্ত করতে চান। তাই
হতাশাকে দূরে ঠেলে ফেলে ঈশ্বরের কাছে করুণা ভিক্ষা করো।
ফস্টাসঃ আহ! প্রিয় বন্ধু আমার, তোমার কথাগুলো যেন আমার বিপন্ন আত্মায়
শান্তির পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে। মুহুর্তকাল আমায় একা থাকতে দাও। আমি আমার পাপের কথা ভাবব।
বৃদ্ধঃ প্রিয় ফস্টাস আমি চলে যাচ্ছি। কিন্তু আমার ভয় হচ্ছে যে তোমার হতাশাগ্রস্ত আত্মা
ধ্বংস হয়ে যাবে। তাই দুঃখভারাক্রান্ত মনেই আমায় যেতে হচ্ছে। [প্রস্থান]
ফস্টাসঃ হা অভিশপ্ত ফস্টাস, ঈশ্বরের ক্ষমা তুমি পাবে কোথায়? আমি অনুতাপ
করি তবু আমার মন
হতাশায় ভরে যায়। আমার আত্মার দখল নেওয়ার জন্য স্বর্গ ও নরকের দ্বন্দ্ব চলছে। মৃত্যুফাদ
এড়ানোর জন্য আমার করণীয় কি?
মেফিঃ ফস্টাস, তুমি বিশ্বাসঘাতক। আমার সার্বভৌম প্রভুর বিরুদ্ধাচরণ করার
জন্য তোমার আত্মাকে আমি শৃঙ্খলিত করছি। যদি ঈশ্বরদ্রোহী না হও, আমি তোমাকে টুকরো টুকরো
করে ফেলব।
ফস্টাসঃ লক্ষ্মী সোনা, মেফিস্টোফিলিস, আমার এই অন্যায় ঔদ্ধত্যের জন্য
আমাকে ক্ষমা করতে তোমার প্রভুকে অনুরোধ কর। লুসিফারের কাছে যে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম রক্ত
দিয়ে পুনরায় তা নবায়ন করব।
মেফিঃ তবে ছলনামুক্ত মন নিয়ে সেটা করে ফেল । অন্যথায় তোমার উপর আরো বড় বিপদ নেমে
আসবে।
ফস্টাসঃ প্রিয় বন্ধু, ঐ ঘূণ্য, ন্যুজ বুড়োটাকে নরক যন্ত্রণা ভোগ করাও। সে
আমাকে তোমার প্রভু লুসিফারের নিকট থেকে দূরে সরিয়ে নেওয়ার দুঃসাহস দেখাচ্ছিল।
মেফিঃ ওর ধর্মবিশ্বাস বড় প্রবল; আমি ওর আত্মাকে স্পর্শ করতে পারব না।
চেষ্টা করলে আমি তার দেহে যাতনার সৃষ্টি করতে পারি কিন্তু তাতে তেমন লাভ হবে না।
ফস্টাসঃ সুজন আজ্ঞাবাহক, তোমার কাছে আমার একটা আব্দার আছে। আমার চিত্তের এই
ঐকান্তিক বাসনাকে পূরণ কর। কিছুক্ষণ আগে স্বর্গীয় রূপের অধিকারী যে হেলেনকে দেখেছি তাকেই যেন
আমার প্রেয়সী হিসাবে পাই। হেলেনের সুধাময় আলিঙ্গনে আমার মনটা সাফ হয়ে যাবে। লুসিফারের কাছে করা প্রতিজ্ঞা
ভঙ্গের দুশ্চিন্তা দূর হবে এবং আমি আমার অঙ্গীকার পালনে সমর্থ হব।
মেফিঃ ফস্টাস, তোমার এই বাসনা অথবা অন্য যে কোন ধরনের আকাখা চোখের পলকেই পূরণ
হবে।
[হেলেনের পুনঃ প্রবেশ।]
ফস্টাসঃ এই কি সেই মুখ যার তরে সাগর পাড়ি দিয়েছিল সহস্র জাহাজ, যার জন্য পুড়ে ছাই হয়েছিল
ইলিয়াম নগরীর সুউচ্চ মিনারগুলো? প্রিয়তমা হেলেন, এসো অধর স্পর্শে অমর কর আমায়। [সে হেলেনকে চুম্বন করে] তার অধরদ্বয় আমার
অন্তরাত্মা শুষে নিয়েছে। দেখ, মন আমার কোথায় উড়ে যাচ্ছে। এসোহেলেন, এসো,
আমার আত্মাকে আবার ফিরিয়ে দাও। আমি তোমাতেই বাস করব কারণ এই অধরজোড়ায় নিহিত আছে স্বর্গের
স্বাদ। হেলেন ছাড়া আর যা কিছু আছে সবই মূল্যহীন। আমি প্যারিসের ভূমিকা গ্রহণ করব।
তোমারি প্রণয়ে এবার ট্রয়ের পরিবর্তে উইটেনবার্গ ধ্বংসস্তুপে পরিণত হবে। দুর্বল মেনিলাসের৫৩
সাথে আমি লড়ব এবং জয়লাভের পর আমার পালকময় শিরস্ত্রাণে এঁকে নিব তোমার শুভেচ্ছার চিহ্ন।
হ্যা, আমি একিলিসের৫৪ গোড়ালিতে আঘাত হানব। তারপর একটি চুম্বন লাভের জন্য ফিরে
যাব হেলেনের কাছে। হে হেলেন, সন্ধ্যার অজস্র তারা ভরা আকাশ ও সান্ধ্য সমীরণের চেয়ে তুমি অধিক রূপময়।
ভাগ্যহীন সেমিলির৫৫ কাছে অনল উজ্জল জুপিটার৫৬ যে রূপে হাজির হয়েছিলেন
তুমি তার চেয়েও উজ্জ্বল। প্রেমাতুর এরিসার৫৭ নীলাভ বাহুডোরে বাধা আকাশপতির চেয়েও
তুমি সুন্দর। তাই তুমি, শুধু তুমিই হতে পার ফস্টাসের প্রণয়িনী ।
[প্রস্থান]
দ্বিতীয় দৃশ্য
ফস্টাসের গৃহ
বৃদ্ধের প্রবেশ
বৃদ্ধঃ হায়, অভিশপ্ত ফস্টাস, তুমি এতই হতভাগ্য যে তোমার আত্মা স্বর্গীয় আশীর্বাদ থেকে
বঞ্চিত হয়েছে এবং ঈশ্বরের বিচারাসন থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। [প্রেতাত্মাদের প্রবেশ] অহঙ্কারী শয়তান
আমার মনে দোলা দিতে চাইছে। এই অগ্নিপরীক্ষার মাধ্যমে ঈশ্বর আমার বিশ্বাস পরখ
করছেন। ঘৃণ্য নরকবাসী, আমার বিশ্বাসের কাছে তোদের পরাজয় ঘটবে। উচ্চাকাংখী
প্রেতাত্মাদের দল, ঐ দেখ, তোদের প্রত্যাখ্যান করায় স্বর্গ কেমন হাসছে আর অবজ্ঞাভরে তোদের বর্তমান
অবস্থাকে বিদ্রুপ করছে । তোরা এই দণ্ডে নরকে ফিরে যা কারণ আমি এখন আমার প্রভু ঈশ্বরের
কাছে ছুটে যাব।
[মঞ্চের একধার দিয়ে বৃদ্ধের এবং অন্য ধার দিয়ে প্রেতাত্মাদের প্রস্থান]
তৃতীয় দৃশ্য
ফস্টাসের গৃহ
[পণ্ডিতদের সাথে ফস্টাসের আগমন]
ফস্টাসঃ আহ, ভদ্র মহোদয়গণ।
প্রথম পণ্ডিতঃ ফস্টাস, কেন আপনি কষ্ট পাচ্ছেন?
ফস্টাসঃ আহ, প্রিয় রুমমেট, আমি যদি আপনার সাহচর্যেই থেকে যেতাম তবে হয়তো আমার আয়ু
দীর্ঘায়িত হতো। কিন্তু এখন আমি অনন্ত মৃত্যুকে বরণ করতে চলেছি। দেখুন তো সে আসছে না কি?
সে কি আসছে?
দ্বিতীয় পণ্ডিতঃ ফস্টাস, আপনি কি বলতে চাইছেন?
তৃতীয় পণ্ডিতঃ সম্ভবত অত্যধিক একাকীত্বের ফলে উনি কিছুটা অসুস্থ হয়ে
পড়েছেন।
প্রথম পণ্ডিতঃ যদি তাই হয়, আমরা ডাক্তার ডেকে ওকে সারিয়ে তুলব। অতিরিক্ত পানাহারের ফলেই এমন
অবস্থা হয়েছে। ও তেমন কিছু না। আপনি শঙ্কিত হবেন না ।
ফস্টাসঃ না, এ হল অতিরিক্ত পাপাচারের কুফল যার দরুন আমার দেহ ও আত্মা উভয়ই অভিশপ্ত ।
দ্বিতীয় পণ্ডিতঃ ফস্টাস, তবুও আপনি ঈশ্বরের ধ্যান করুন। মনে রাখবেন
ঈশ্বরের করুণা অসীম।
ফস্টাসঃ কিন্তু ফস্টাসের অপরাধ কখনই ক্ষমার যোগ্য নয়। যে সাপ ঈভকে
প্রলুব্ধ করেছিল, সেও হয়তো পরিত্রাণ পেতে পারে, কিন্তু ফস্টাস পাবে না। আহ, ভদ্রমহোদয়গণ ধৈর্য্য ধরে আমার কথা
শুনুন। আমার বক্তব্য শুনে ভয়ে কাপবেন না । যখন মনে পড়ে বিদ্যার্থী হিসাবে সুদীর্ঘ
তিরিশ বছর এখানে কাটিয়েছি তখন আমার হৃদয় স্পন্দিত ও শিহরিত হয়ে উঠে। হায়! আমি যদি কখনো উইটেনবার্গ দর্শন না করতাম কিংবা কোন গ্রন্থই
যদি পাঠ না করতাম। কেবল জার্মানী নয় সারা বিশ্বই দেখেছে আমি কি বিস্ময়কর সব কাণ্ড ঘটিয়েছি ।
অথচ সেজন্যই ফস্টাস আজ জার্মানী ও দুনিয়া এমন কি স্বর্গ পর্যন্ত হারাচ্ছে। হ্যা, স্বর্গ, যা
হল ঈশ্বরের আসন, পূণ্যাত্মাদের নিবাস এবং আনন্দের রাজ্য তা ফস্টাস হারাচ্ছে
এবং তাকে নরকে-হ্যা নরকেই চিরটা কাল কাটাতে হবে। প্রিয় বন্ধুরা, বলুন, নরকে এই ফস্টাসের
কি পরিণতি হবে?
তৃতীয় পণ্ডিতঃ সে যাই হোক, ফস্টাস, আপনি ঈশ্বরকে ডাকুন।
ফস্টাসঃ ঈশ্বর! যাকে ফস্টাস পরিত্যাগ করেছিল? যাকে সে অশালীন ভাষায় আক্রমণ করেছিল? হা ঈশ্বর,
আমি কাঁদতে চাই কিন্তু শয়তান আমার চোখের জলও হরণ করেছে। অশ্রু না থাক রক্তধারা ঝরুক। হ্যা, জীবন ও
আত্মা দেহ থেকে নির্গত হোক। ওহ, সে আমার জিহবাও অনড় করে দিয়েছে। আমি প্রার্থনার জন্য হাত তুলতে চাই
কিন্তু দেখুন তারা আমার হাত পর্যন্ত ধরে রেখেছে।
পণ্ডিত বর্গঃ ফস্টাস, ওরা কারা?
ফস্টাসঃ লুসিফার ও মেফিস্টোফিলিস। হায়, সুভদ্রজন, আমি যাদুবিদ্যায় দক্ষতা অর্জন করার জন্য
তাদেরকে আমার আত্মা দান করেছিলাম।
পণ্ডিতবর্গঃ ঈশ্বর না করুন।
ফস্টাসঃ বাস্তবিকই, ঈশ্বর আমাকে নিষেধ করেছিলেন, কিন্তু আমি ফস্টাস তা শুনিনি। মাত্র চব্বিশ বছরের তরে মেকি আনন্দ ভোগ
করতে গিয়ে হারিয়েছি পরম ও চিরস্থায়ী সুখ। আপন রক্তের অক্ষরে আমি শয়তানকে আত্মা সম্প্রদানের
অঙ্গীকার নামা লিখে দিয়েছি। নির্ধারিত সময়সীমা প্রায় অতিবাহিত হয়েছে। চূড়ান্ত মুহুর্ত
এলেই সে আমার আত্মা নিয়ে যাবে।
প্রথম পণ্ডিতঃ ফস্টাস, আপনি এসব কথা আগে বলেন নি কেন? আগে জানলে তো, যাজকরা আপনার জন্য
প্রার্থনা করতে পারত।
ফস্টাসঃ প্রায়ই আমি তেমন কিছু করার চিন্তা করেছি। কিন্তু যখনই আমি ঈশ্বরের নাম নিতাম বা
ঈশ্বরের কথা একবারের জন্যও শ্রবণ করতাম, শয়তান আমার শরীর ও আত্মা উভয়ই হরণের ভয়
দেখাত। কিন্তু এখন অনেক দেরী হয়ে গিয়েছে। সুভদ্রজন, আপনারা চলে যান নইলে আমার
সাথে সাথে আপনারাও শেষ হয়ে যাবেন।
দ্বিতীয় পণ্ডিতঃ ওহ, ফস্টাস বলুন, আপনাকে রক্ষার জন্য আমরা কি করতে পারি?
ফস্টাসঃ আমার সম্বন্ধে আলোচনা বাদ দিন। এখান থেকে চলে যান ও নিজেদের রক্ষা করুন।
তৃতীয় পণ্ডিতঃ আমি ফস্টাসের সাথেই অবস্থান করব। ঈশ্বর আমাকে শক্তি
যোগাবেন।
প্রথম পণ্ডিতঃ প্রিয় বন্ধু, দোহাই আপনার, ঈশ্বরের শক্তি পরখ করবেন না। বরং
চলুন পাশের ঘরে গিয়ে ফস্টাসের জন্য প্রার্থনা করি।
ফস্টাসঃ হ্যা, প্রার্থনা; প্রার্থনাই করুন আমার জন্য। কোন শব্দ শুনতে পেলেও আমার কাছে আসবেন না
কারণ কোন কিছুই আর আমাকে রক্ষা করতে পারবে না।
দ্বিতীয় পণ্ডিতঃ আমরা প্রার্থনা করব, ঈশ্বর যেন আপনাকে ক্ষমা করেন। অবশ্য আপনি নিজেও প্রার্থনা
করুন।
ফস্টাসঃ ভদ্রমহোদয়গণ, বিদায়। যদি সকাল অবধি বাচি তবে আপনাদের সাথে সাক্ষাৎ করব; যদি
দেখা না হয় বুঝবেন ফস্টাস নরকে যাত্রা করেছে।
পণ্ডিতবর্গঃ বিদায় ফস্টাস, বিদায়। [পণ্ডিতরা চলে গেলেন, ঘড়িতে এগারোটা
বাজল]
ফস্টাসঃ আহ, ফস্টাস, তোমার আয়ু আর মাত্র একটি
ঘন্টা। তারপর তুমি অবশ্যই চিরতরে অভিশপ্ত হবে। চির চলমান গ্রহ-নক্ষত্রমণ্ডলী তোমরা
স্থির হয়ে দাড়াও যেন সময়ের গতি স্তব্ধ হয়ে যায়। মধ্যরাতের আগমন যেন কখনই না ঘটে ।
লাবণ্যময়ী প্রকৃতির নয়ন, জাগো, পুনর্বার জেগো ওঠো, আনো অনন্ত দিন। নয়তো এই এক ঘন্টাই
দীর্ঘায়িত হয়ে হোক একটি বছর, একটি মাস, একটি সপ্তাহ অথবা নিদেনপক্ষে একটি পূর্ণ দিবস।
তাহলে ফস্টাস অনুশোচনার সুযোগ পেতে পারে; নিজের আত্মাকে রক্ষা করতে পারে। হে রাতের
অশ্ব, ধীরে ধীরে ধীরে চল । কিন্তু না, নক্ষত্ররাজি এখনও চলমান। সময় ছুটে চলেছে,
ঘড়িতে ঘোষিত হবে সেই ঘন্টা, শয়তানের আবির্ভাব ঘটবে এবং ফস্টাস অভিশপ্ত হবেই।
ওহ, আমি ঈশ্বরের কাছে। ছুটে যাব। কিন্তু কে যেন আমায় নীচে টানছে? দেখ, ঐ দেখ, আকাশে ঈশ্বরের করুণার শোণিত ধারা বয়ে চলেছে। তার একটি বিন্দুই, এমন কি
অর্ধ বিন্দু আমার আত্মাকে রক্ষা করতে পারে। হে ঈশ্বর, হে আমার ত্রাণকর্তা! আহ! আমার প্রভুর নাম উচ্চারণের জন্য আমার হৃদয়টাকে
ছিন্ন বিচ্ছিন্ন কর না। তা করা সত্ত্বেও আমি তাকে ডাকব। হে লুসিফার, আমায় রেহাই দাও।
কিন্তু কোথায় সেই পবিত্র শোণিত? তা আর নেই। দেখ, ঈশ্বর তার বাহু প্রসারিত করেছেন,
তার ললাট ক্রোধে কুঞ্চিত। পাহাড়-পর্বত তোমরা আমার উপর পতিত হও, ঈশ্বরের
ক্রোধাগ্নি থেকে আমায় আড়াল করে রাখ।
না, না। হে ধরণী দ্বিধা হও, আমি তবে তোমার গহরেই ছুটে যাব। হায়, সেও আমায় আশ্রয়
দেবে না। হে তারকারাজি, তোমরা যারা আমার জন্মলগ্নে আকাশে বিরাজমান ছিলে, তোমরা জলভরা মেঘপুঞ্জের ভিতর আমাকে কুয়াশার রূপে নিয়ে যাও।
সৃষ্টির বেদনায় উনুখ মেঘপুঞ্জ যখন বমন করবে তখন তোমার ধূমায়িত মুখগহবর থেকে
নির্গত হয়ে আমার আত্মা যেন স্বর্গপানে যাত্রা করতে পারে।
[ঘড়িতে অর্ধঘন্টা অতিক্রমের সঙ্কেত ধ্বনিত হয়]
আহ, আধ ঘন্টা চলে গেল। অচিরেই বাকী সময়টুকু অতিক্রান্ত হবে। হে ঈশ্বর, আমার আত্মার
জন্য যদি আপনার করুণা নাও থাকে তবু যীশুর দোহাই, আমার এই অবিরাম যন্ত্রণার উপশম
ঘটান। ফস্টাস নরকে সহস্র নয় শত সহস্র বছরও কাটাতে রাজী তবু যেন সে শেষ পর্যন্ত রক্ষা
পায়। হায়, অভিশপ্ত আত্মার যন্ত্রণার যে কোন সমাপ্তি নেই! হায়, ফস্টাস কেন
তুমি আত্মাহীন প্রাণী হলে না? কেনই বা তোমার আত্মা অমর? আহ, পিথাগোরাসের৫৮
মেটেমসাইকোসিস তত্ত্ব৫৯ যদি সত্য হতো, তাহলে আমার আত্মা দেহ থেকে উড়ে যেত এবং আমি কোন বর্বর পশুতে
রূপান্তরিত হতাম। সকল পশুই সুখী কেননা ওরা যখন মরে ওদের আত্মা জাগতিক উপাদানের
সাথে মিশে যায়। কিন্তু নরকযন্ত্রণা ভোগ করার জন্য আমার আত্মাটি অবশ্যই জীবিত
থাকবে। যে পিতামাতা আমায় জন্ম দিয়েছে তারা অভিশপ্ত হোক। না, না। ফস্টাস, তুমি অভিসম্পাত দাও
নিজেকে; অভিসন্দাত দাও সেই লুসিফারকে যে তোমায় স্বর্গের আনন্দ থেকে বঞ্চিত করেছে। [ঘড়িতে বারোটা
বাজার শব্দ শোনা গেল]
হায়, হায়, ঘন্টা বাজছে, ঘন্টা বাজছে। হে আমার দেহ, এখন বাতাসে পরিণত হও নইলে
লুসিফার তোমায় দ্রুত নরকে নিয়ে যাবে। [বজ্রপাতের শব্দ ও বিদ্যুতের ঝলক] হে আত্মা আমার, তুমি
ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জলবিন্দুতে পরিণত হও; তুমি মহাসাগরে পতিত হও যেন কেউ কখনো তোমার
সন্ধান আর না পায়।
[শয়তানদের প্রবেশ]
ঈশ্বর হে ঈশ্বর, নির্দয় দৃষ্টিবাণে আমায় আর বিদীর্ণ করবেন না। ছোট বড় সর্পকুল, আমাকে এক মুহুর্তের তরে বুকভরে
দম নিতে দাও। ওহে কুৎসিৎ নরক, দ্বার উনুক্ত করো না। লুসিফার, হেথায় এসো না। আমি
আমার গ্রন্থরাজি পুড়িয়ে ছাই করে দেব। আহ, মেফিস্টোফিলিস! [ফস্টাসকে সঙ্গে
নিয়ে শয়তানদের প্রস্থান]
[কোরাসের প্রবেশ]
কোরাসঃ ফস্টাস মহাপ্রস্থান করলেন। যে বৃক্ষ ঋজুভাবে পূর্ণ বিকশিত হতে পারত তা কর্তিত হল। এই
বিদ্বান লোকটির অন্তরে অ্যাপোলোর৬০ আশীর্বাদে যে কবিপ্রতিভা রূপ বৃক্ষ৬১
মাঝে মাঝে বিকশিত হত তাও ভস্মীভূত হল। আপনারা তার নারকীয় পতন দেখুন। বুদ্ধিমান ব্যক্তিরা তার
নির্মম পরিণতি দেখে শিখুন যে নিষিদ্ধ শাস্ত্রের রহস্য সম্বন্ধে শুধু বিস্মিতই হওয়া উচিত কারণ এর দুর্জেয়
রহস্য ফস্টাসের ন্যায় প্রাজ্ঞ ব্যক্তিদেরও প্রলোভিত করে। ফলে তারা ঈশ্বর প্রদত্ত স্বাধীনতার
সীমা অতিক্রম করে ইন্দ্রজাল চর্চা করেন ও সর্বনাশ ডেকে আনেন।
[কোরাসের প্রস্থান]
‘দিন শেষের ঘন্টা
বাজে, নাট্যকার লেখা শেষ করেন’।
প্রথম দুই অঙ্ক পড়ে ভালো লাগলো। তাই পুরোটা এক বসায় শেষ করে ফেলি।
ReplyDeleteতবে মনে হচ্ছে, আগের মতই এখনো আত্না বিক্রি করে শয়তানের উপাসনা করা হয়।
We should learn some things from the drama.
ReplyDeleteদারুণ
ReplyDelete