Games at twilight - Anita Deshai - Bangla translation - গেমস এট টুইলাইট - অনিতা ডেশাই - বাংলা অনুবাদ
অন্যান্য লিঙ্কসমূহ
১। শব্দার্থ ও টিকাসমূহ
২। মূল ইংরেজি টেক্সট
অন্যান্য লিঙ্কসমূহ
১। শব্দার্থ ও টিকাসমূহ
২। মূল ইংরেজি টেক্সট
গেমস অ্যাট টুইলাইট
সময়টা এত
উষ্ণ ছিল যে, বাইরে খেলাধুলা করার কোনো পরিস্থিতি ছিল না। তারা চা পান করল, চুল
আচড়াল। সূর্যের কড়া তাপ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ছেলেমেয়েরা সরাদিন একটি ঘরে
আবদ্ধ ছিল। একসময় ছেলেমেয়েরা ঘর থেকে বের হওয়ার সাথে সাথে বেপরোয়া হয়ে উঠল।
তারা অনেক চেষ্টা করে কান্নায় চোখমুখ লাল করেও বাইরে বের হওয়ার অনুমতি পায়নি
মার কাছ থেকে। পুরো স্থানটি পর্দা দিয়ে এমনভাবে ঢাকা ছিল যে, যা ছেলেমেয়েদের এক
শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় ফেলে দিয়েছিল। এ কারণে ছেলেমেয়েদের মনে হচ্ছিল যে তাদের হৃদপিণ্ড নরম তুলোর মতো উল দ্বারা
বোঝাই, আর নাকের ছিদ্রপথে ধুলোর প্রলেপ। এখন যদি তারা এ আবরণ থেকে মুক্ত হয়ে বাইরে সূর্যালোকে হাজির
হয়ে তাজা বাতাস গ্রহণ না করে তাহলে দম বন্ধ হয়ে মারা পড়বে। ছেলেমেয়েগুলো অনুনয় করে বলতে লাগল,
মা অনুগ্রহ করে আমাদের কথা শোন, আমরা বারান্দা ছেড়ে বাইরে যাবো না, এখানেই খেলবো। তোমরা অবশ্যই যাবে,
আমি জানি তোমরা যাবে এবং তারপর না, আমরা বাইরে যাব না, আমরা যাব না বলে ছেলেমেয়ে গুলো এমনভাবে
অনুনয়-বিনয় করতে লাগল যে, শেষে মা সামনের
দরোজাটা খুলে দিলেন। এর ফলে ছেলেমেয়েগুলো বীজপাত্র হতে পাকা শস্য কণার ছড়িয়ে পড়ার
মতোই উল্লাসে উন্মত্ত হয়ে বারান্দা বরাবর এগিয়ে চললো চিৎকার করতে করতে। অতঃপর মহিলা
নিত্যদিনই যেটা করেন, যেমন, হৈ চৈ করে গোসল সমাপ্ত করেন আর গ্রীষ্মের বিকেলে ধোপদুরস্ত
শাড়ি পরে প্রচুর পাউডার মাখেন সারা শরীরে।
ওরা বিকেলের
মুখোমুখি এখন, সময়টা ছিল খুবই গরম, সূর্যের তাপ ছিল কড়া। বারান্দার সাদা দেয়ালগুলো
সূর্যালোকে ঝলসে যাচ্ছে। বোগেনবোলিয়ার ঝাড় ঝুলে আছে আবছা লাল আর মেজেন্টা রঙের আভা
মেখে ফুসে ওঠা বেলুনের মতো। বাইরের বাগানের দিকটা মনে হচ্ছে পেটানো তামার ট্রের মতো। বাইরের সমতল
পাথুরে মৃত্তিকায় এলুমিনিয়াম, টিন, তামা আর ব্রোঞ্জ সকল ধাতুর ছাপ পড়েছে একসাথে। এমন তীব্র দিনে সকল
প্রাণস্পন্দন যেন স্তব্ধ, পাখিগুলো যেন বৃক্ষে শুকিয়ে যাওয়া ফলের মতোই প্রাণহীন বৃক্ষপত্রে
ঢাকা তাবুর আশ্রয়ে। কিছু কিছু কাঠবিড়ালি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে আসে বাগানের জলের কলের নিচের
ভেজা মাটিতে নিজেদের সিক্ত করে নিতে। বাইরের বারান্দার পাপোষে কুকুরটা মৃতের মতো পড়ে থাকে।
তার থাবা, কান আর লেজ তৃষ্ণার্ত মৃতপ্রায় পথিকের মতো পড়ে থাকে। সে তার সাদা মার্বেলের
মতো শিশুসুলভ চোখ দুটো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে অনুকম্পা প্রার্থনা করে আর হঠাৎ করেই লেজটি
ঘুরাতে গিয়ে ব্যর্থ হয়। সেটি একটু নড়াচড়া করেই আবার আগের মতো স্থির হয়ে পড়ে থাকে। এরপরই ছেলেমেয়েদের
চিৎকারে একঝাক টিয়া ইউক্যালিপটাস বৃক্ষের শাখা থেকে উড়াল দিয়ে উষ্ণ হাওয়া কেটে কেটে এগিয়ে চলে। তারপরই
পাখিগুলো যুদ্ধক্ষেত্রের মতো। আওয়াজ তুলে সাদা আকাশের একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে
ছুটে যায়।
মুক্ত হয়ে
ছেলেমেয়েরা মোটামুটি স্বস্তি অনুভব করছে। তারা একে অপরের সাথে লাফঝাপ ধাক্কাধাকি
শুরু করেছে। শুরুটা কী? শুরু করেছে তাদের কর্ম। কর্মটা হল বাচ্চাদের দিনব্যাপী খেলা ।
চলো সবাই
লুকোচুরি খেলি।
খুঁজবে কে?
তুমি
খুঁজবে।
আমি কেন?
তুমি কেন নয়?
তুমি সবার
বড় তাই--
কিন্তু এটার
মানে তো এই নয় যে--
প্রচণ্ড
ধাক্কাধাক্কি শুরু হল, কেউ কেউ লাথি মারল, মমতাময়ী মিরা মধ্যস্থতা করতে এলেন, প্রচণ্ড
ধাক্কা মেরে তিনি ছেলেমেয়েদের থামালেন। কাপড় চোপড়ের খচমচ শব্দ থেমে গেল কান্নার ফোপানি
আর হাপানোর শব্দে, ঘাড়ে যে এক ফালি কাপড় ঝুলছে সেদিকে তখন কারো দৃষ্টি দেয়ার অবকাশ ছিল না।
বৃত্ত রচনা
করো, গোল হও, চিৎকার করে ঠেলেলে তিনি ছেলেমেয়েদের নিয়ে বৃত্ত তৈরির চেষ্টা করতে
লাগলেন। এবার সবাই হাততালি দাও, নির্দেশ দিয়ে নিজেই হাততালি দেয়া শুরু করতেই
ছেলেমেয়েরা সবাই বিষাদভরা কণ্ঠে গাইতে লাগল, ডুবে গেল, ডুবে গেল। আমার নীল তরী.. আর
সবাই একে অপরকে দেখছে আর একতালে সবাই হাতের উপর হাত ফেলছে, এরপর তারা লাফ দিয়ে উৎফুল্ল
চিত্তে বৃত্ত ভেঙ্গে বের হয়ে এল। রঘু ছিল এদের একজন। হঠাৎ সে প্রতিবাদের সুরে বলতে
লাগল, তুমি ফাকি দিয়েছ মিরা, তুমি ফাকি দিয়েছ, কিন্তু এরই মধ্যে সবাই সরে পড়েছে এ
কারণে প্রতিবাদ করে কোনো লাভ হল না। সে যখন ডেকে বলছিল, মা বলেছেন, মা বলেছেন,
শুধু বারান্দা আর চত্বরে থাকবে কিন্তু এসব শোনার মতো তখন সেখানে কেউ ছিল না, কিন্তু
ওর কথা কেউ না শুনে, যে যার ইচ্ছেমতো ছুটল। সে দেখল ধুলোর মধ্যে ঝোপেঝাড়ে ওদের
বাদামি পা গুলো প্রতিফলিত হচ্ছে, ওরা দেয়ালের উপর উঠে ওপাশে চলে গেল আর মুহুর্তের
মধ্যে বাগানবাড়ি খালি হয়ে গেল। বোগেনবোলিয়ার খয়েরি ছায়া বুকে ধরে বাগানটা আবার নীরব হয়ে গেল।
কাঠবিড়ালিগুলোও সরে পড়ল । পুরো স্থানটা এখন নীরব সুনসান ।
শুধু ছোটো
মনুকে একবার দেখা গেল, মনে হল অদৃশ্য মেঘের আড়াল হতে সে খসে পড়েছে; কিংবা পাখির
নখর থেকে নিচে পড়ে গেছে। কিছুক্ষণের জন্য হলুদাভ লনে সে একটু দাঁড়াল আর নিজের
আঙুল কামড়াতে কামড়াতে ওর চোখে জল ভরে এল, রঘুর চিৎকার শোনামাত্রই সে তার মাথা দেয়ালে ঠুকে বলতে থাকল, তিরাশি, পঁচাশি, উননব্বই, নব্বই—
এরপরই সে
ভীত হয়ে একবার উত্তর পাশে একবার দক্ষিণ পাশে পালানোর উপায় খুঁজছিল। রঘু হঠাৎ করে ঘুরে
দাড়িয়ে মনুর সাদা অবয়ব দেখতে পেয়ে লালরঙা স্কেটিং স্যান্ডেল পরা অবস্থায় রক্তে শিহরণ তোলা মূর্তি নিয়ে তাড়া করল। মনু
হোচট খেয়ে হোসপাইপের ওপর উঠতেই সেখান থেকে ধপাস করে রাবার কয়েলের ওপর পড়ে গেল,
শুয়ে থেকে কান্নাজড়িত স্বরে বলতে লাগল, আমাকে নয়, অন্য সবাইকে তুমি খুঁজে বার
করো।
রঘু পায়ের
গোড়ালি দ্বারা মনুকে লাথি মেরে বলল, আমি জানি, তুমি একটা আহাম্মক, তুমি মৃত; তৃপ্তি
সহকারে বলল সে, তার উপরের ঠোঁট দ্বারা ঘাম চুষতে চুষতে দ্রুত অন্যদের উদ্দেশ্যে ধাবিত হল
খোজ করার জন্য। প্রচণ্ড জোরে সে শিস দেয়া শুরু করল যাতে লুকিয়ে থাকা দল ভয় পেয়ে
পায়।
শিস শুনে
রবি দ্রুত তার নাক চেপে ধরল এবং টানেলের ফাঁপা দেয়ালে আঙুলের সাহায্যে ডিপ ডিপ শব্দ করতে
লাগল। সে বাগানের গ্যারেজে একটি ফুলের টবের আড়ালে নিজেকে লুকিয়ে রেখে নিরাপত্তাহীনতায়
ভুগছিল ভীত মনে। কোথায় লুকোবে সে? রঘুর পায়ের আওয়াজ পাওয়ামাত্র সে বড়োজোর গ্যারেজের
চারপাশে দৌড়াতে পারবে, কিন্তু সে তার ছোটো ছোটো পা নিয়ে ফুটবল খেলার লোমশ পায়ের বড়ো
বড়ো পদক্ষেপের নিকট অবশ্যই হার মানবে, নিজের পায়ের প্রতি বিশ্বাস রাখতে পারছে
না। ক্রটন আর হিবিসকাস গাছের জঙ্গল ভেদ করে রঘু যখন ক্রমাগত সামনে এগিয়ে আসছিল রবি তখন
ভয়ে তার গলায় আটকে থাকা নাকের শ্লেষ্মা চট করে গিলে ফেলল।
গ্যারেজ ছিল
তালাবদ্ধ আর চাবি ছিল ড্রাইভারের হাতে। চাবিটি দেয়ালে রাখা ড্রাইভারের শার্টের পকেটে বুলছিল । রোমশ বুকের
অধিকারী রঘুর নাক ঝাড়ার শব্দে রবি উকি দিয়ে দেখল, ডোরাকাটা খাটো একটা প্যান্ট
পরে রঘু এখনো দড়ির খাটিয়ার চারপাশে পায়চারি করছে। রবি ভাবল সে যদি কিছুটা বড়
এবং শরীরে লম্বা হত তাহলে চাবিটা সহজেই হস্তগত করতে পারত, কিন্তু এর জন্য তাকে আরো
অনেক বছর অপেক্ষা করতে হবে। দুঃখভারাক্রান্ত মনে সে তারই সমান উচু প্রায় একটি
ফুলের টবের সামনে বসে পড়ল। কিন্তু গ্যারেজের পাশেই একটি চালাঘর ছিল সবুজ রঙের
দরজাযুক্ত, এটাও ছিল তালাবদ্ধ, এর চাবি কার কাছে কেউ তা জানে না। এই চালাঘরটি তখনই খোলা হয় যখন
ওর মায়ের পুরনো জিনিসপত্র বিশেষ করে ছেড়া মাদুর, পুরনো বালতি এগুলো রাখার
প্রয়োজন হয়। সাদা পিপড়ার দঙ্গল, মাকড়সার জাল আর ইদুরের গর্ত সবকিছুকেই ঢেকে দিয়েছে।
মনে হচ্ছিল পুরো
জায়গাটা কেউ দখল করে লুটপাট করেছে। দরোজার সামনে ঝাঁকে আছে সবুজ পত্রালি, সেগুলো
প্রায় দরোজার জং ধরা কব্জার কাছে এসে পড়েছে। দরোজার পাল্লার ফাকা এতটাই ছিল যে, শুধু ইদুর আর কুকুর
নয়, রবি নিজেও সহজে এর মধ্যে ঢুকে পড়তে পারে।
এ রকম একটি
ভয় জাগানো অন্ধকারাচ্ছন্ন স্থান যেখানে সব জিনিসপত্র বিক্ষিপ্ত অবস্থায় পড়ে আছে, জন্তু
জানোয়ারের ভয়জাগানো ভীতি সঞ্চারকারী ঘরে রবি আগে কখনোই ঢোকার চিন্তা করেনি। রঘুর
চিৎকার যখন ক্রমেই জোরালো আর তীব্র হয়ে উঠল তখন রবি অকস্মাৎ ফলের টবটা পিছলে
পেছনের ফাঁকা জায়গা দিয়ে একেবারে ভেতরে চলে এল । এবার ওর ঠোঁটে একটু মৃদু হাসি খেলে গেল ওর নিজেরই
বোকামির জন্য। রঘু নিঃশব্দে এগিয়ে এসে ওর হাত ও কোমর সাপটে ধরে শেষে চিৎকার করে
অট্টহাসি হেসে বলল, তোমার শব্দ পেয়েছি, আসছি আমি এইতো পেয়েছি তোমায়। কিন্তু ঝোপজঙ্গল ভেঙে রঘু
এখানে এসে উল্টে যাওয়া ফুলের টব, হলুদরঙা ধুলো আর সাদা পিঁপড়ার দঙ্গল ছাড়া কিছুই পেল না। একটি ছোট লাঠি হাতে নিয়ে রঘু
গ্যারেজের দেয়ালে জোরে জোরে ঘষতে লাগল যেন শিকার বাইরে বের করে নিয়ে আসতে চাচ্ছে।
রবি খুশিতে
আপ্লুত হয়ে পড়ে এবং
মনে মনে নিজেকে ধন্যবাদ জানাতে থাকে। এর সাথে আছে ভয়। এটা ছিল পুরো ঢাকা দেয়া ভৌতিক অন্ধকার
স্থান যা কবরস্থানের কথা মনে করিয়ে দেয়। রবি একবার লিলেনের আলমারিতে আটকা পড়েছিল।
সেখান থেকে উদ্ধার পাওয়ার পূর্বের আধ ঘন্টা তাকে কাঁদতে হয়েছিল, কিন্তু স্থানটি ছিল তার
নিত্য পরিচিত। সেখানে ওর মায়ের রাখা মাড় দেয়া কাপড়ের গন্ধের মাঝে ওর মায়ের পরশ মনে করিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু
এই অন্ধকার ছাউনিটা ধুলোবালি, মাকড়সা আর ইঁদুরের গন্ধে পরিপূর্ণ আর কেমন যেন অদ্ভুত একটা ভৌতিক পরিবেশ
বিরাজ করছিল এর ভেতর, অন্ধকার তো আছেই। দরজার ফাকা জায়গা ভেদ করে আসা এক চিলতে সাদা আলো ছাড়া
কোনো আলো ছিল না। ছাদটা ছিল খুবই নিচু। রবি ছোটো হলেও তার মনে হল সহজেই সে আঙুল উচিয়ে ছাদটি
ছুঁতে পারে। কিন্তু
নিজেকে সে সর্বদা জড়োসড়ো করে রাখল আসন্ন বিপর্যয় হতে রক্ষা পাওয়ার জন্য। এমন বিষয় কী
আছে যা তাকে স্পর্শ করতে পারে এবং তার উপস্থিতি টের পেতে পারে।
এ অন্ধকারে?
ঠাণ্ডা পিছল যা সাপের মতোই কোনো বস্তু । সাপ! আর সে মুহুর্তেই রঘু লাঠি দিয়ে আঘাত করল
দেয়ালে আর এ শব্দটিই তার মাঝে কিছুটা নিরাপত্তা এনে দিল । সে রঘুর লাঠির আওয়াজ শুনতে
পাচ্ছে। কিন্তু রঘু তাড়াতাড়ি অন্যদিকে চলে গেল, গ্যারেজ পার হওয়ার সাথে সাথে তার
পায়ের শব্দও থেমে গেল। চালাঘরের মধ্যে ভয়ে তার শরীরটা শীতল হয়ে গেল। ভয়ে সে কাঁপা শুরু করল,
মনে হল কি যেন একটা তার
ঘাড়ে সুড়সুড়ি দিচ্ছে সাহস করে রবি একটু মাথা উঁচু করল বিষয়টি কী দেখার জন্য। এটি
একটি পোকা, অবশ্যই মাকড়সা। খুঁজে পেয়েছি এটি। সে এটাকে পিষে ফেলতেই দেখতে পেল আরো পোকামাকড় তাকে
স্পর্শ করার জন্য এগিয়ে আসছে। এখন আর কিছু করার নেই, সে বুঝতে পারল ঘাড়ে হাত দিয়ে
পিষে ফেলা মাকড়সার শরীরের রস শুকিয়ে তার গায়ে লেগে গেছে। এরপর বেশ কয়েক মিনিট ধরে সে ভয়ে
কাপতে লাগল। এরই মাঝে অন্ধকারে সে দেখতে পেল পুরনো কাঠের ওয়্যারড্রব, ভাঙা
বালতি, লাঠি, ছিন্ন বিছানার চাদর সব স্তূপ করে রাখা হয়েছে এ স্থানে। নজরে পড়ল একটি এনামেলের বাথটাব, শেষে ওটার
নিচে দিয়ে নিচু হতে চেষ্টা করল।
সে ভালো করে
দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ভাবল ছাউনির তলা দিয়ে গড়িয়ে যাওয়া যায় কি না। আর এ মূহুর্তে রঘুর
হাতে ধরা দেয়া ঠিক হবে কি না এটাও ভাবল। এই অন্ধকার জায়গার চাইতে খোলা হাওয়া,
বাইরের রোদ, ভাইবোন ও চাচাতো মামাতো ভাইবোনদের সাথে মিলিত হওয়াটাই অধিক ভালো বলে মনে হল ওর
কাছে। আর একটু পরেই বিকেলের ছায়া নামবে।
তখন আর
খেলায় কোনো বাধা থাকবে না। মা-বাবা সবাই বেতের চেয়ারে বসে বসে দেখবেন। কীভাবে তাদের
ছেলেমেয়েরা ঘোরাফেরা করছে আর দল বেঁধে কীভাবে বাগান থেকে মালবেরি আর জামুন সংগ্রহ
করে জড়ো করছে। মালি পানির কলের সাথে পাইপ লাগিয়ে বাগানে জলসেচ দেবে, ভিজে যাবে
শুকিয়ে যাওয়া হলুদ ঘাসগুলো আর লাল নুড়িপাথর মেশা মাটিতে পানির স্পর্শে বের হবে
সোদা সুগন্ধ, যেন পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সুগন্ধ সেটি। রবি নাক দিয়ে সে সুগন্ধ নেয়ার চেষ্টা করল।
বাথটাবে দাড়িয়ে রবি একটি মেয়ের চিকার শুনতে পেল, রঘু তাকে ঘেরাও করেছে, ধুপধাপ শব্দ হচ্ছে আবার, বাগানের
ঝোপঝাড়ে গড়াগড়ির শব্দও পাওয়া যাচ্ছে। আবার মাঝে মাঝে ছেলেমেয়েদের চিৎকার আর অভিযোগের শব্দও পাওয়া যাচ্ছে, আমি ঘর
ধরেছি, তুমি না আমি, তুমি মিথ্যুক, না এটা তুমি করোনি, এরপর থেমে গেল
সব শব্দ আবার নীরবতা।
রবি
বাথটাবের অমসৃণ কিনারায় বসে ছিল। কী মজা! সবাই যদিও ধরা পড়েছে, শুধু একমাত্র সে এখনো
ধরা পড়েনি। এমন অনুভব তার মাঝে আর কখনো জাগেনি। এমন অদ্ভুত বিস্ময়কর অনুভূতি
তার জীবনে আর কখনো জাগেনি। একবার তার চাচা এক থলে চকলেট তাকে উপহার দিলে এমন ভাব অবশ্য সে
সময় জেগেছিল। কিংবা সোডা বিক্রেতা তার ঘোড়ার গাড়ি নিয়ে গেটের সামনে এলেও তার মনে এমন ভাব
জাগত। বন্ধুসুলভ লাল দাড়িওয়ালা গাড়িচালকের শব্দ এখনো তার কানে বাজে। রঘুর মতো এমন একজন কর্কশ
কণ্ঠের অধিকারী পাকা ফুটবল খেলোয়াড়কে ফাকি দিয়ে নিজেকে অপরাজিত রাখার একটা আনন্দ তার কাছে
একটা রোমাঞ্চকর ব্যাপার বলে মনে হল। নিজেই নিজের হাঁটু লজ্জায় জড়িয়ে ধরে বিজয় গৌরবের লরেল মুকুট
পরার কথা মনে হল ওর।
বসে বসে সে
হাসছিল সেখানে আর তার পায়ের জুতোর হিল দ্বারা বাথটাবে বার বার আঘাত করছিল। মাঝে
মাঝে উঠে গিয়ে দরোজার ফাকে কান পেতে বাইরে ছেলেমেয়েদের খেলার শব্দ আর হৈ হল্লা শুনছিল। মনে
হচ্ছিল সে-ই হবে শেষ পর্যন্ত বিজয়ী। সে তার বিজয় দ্বারা অন্যদেরও ছাড়িয়ে যাবে। ক্রমে দরোজার ফাক
দিয়ে আসা আলো স্নান হয়ে এলে চালাঘরের ভেতরটা আরো অন্ধকার হয়ে আসতে থাকে। ক্রমেই
ছড়িয়ে পড়ল বেজির লোমের মতো হলুদাভা এরপরেই তা নীল হল, তারপরেই ধূসর । বিকেল
ক্রমেই পরছে আঁধারের আবরণ । ঝপঝপ পানি পড়ার শব্দ শোনা যাচ্ছে। মাটি পানি দিয়ে তৃষ্ণা নিবারণ করে
অদ্ভুত সুগন্ধ ছড়িয়ে দিচ্ছে সবার জন্য।
রবি লক্ষ
করল, চালাঘরের দীর্ঘ লাল ছায়া, চালাঘর আর গ্যারেজের ছায়াই তখন উঠানে গিয়ে পড়েছে। তার সামনেই
দেখা যাচ্ছে ঘরের সাদা দেয়াল, বোগেনবোলিয়া হারিয়েছে তার সৌষ্ঠব, যেখানে
দিনের বেলায় চড়ুইপাখিরা তাদের কিচিরমিচির শব্দে সদা সরব থাকত। চত্বরের বারান্দাটা
তার সৃষ্টির আড়ালে ছিল। ও কি ছেলেমেদের কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছিল? মনে হল সে যেন সবই শুনতে পাচ্ছে। ও
যেন ওদের হাসির শব্দ, সঙ্গীতের শব্দ শুনতে পাচ্ছিল। কিন্তু তখন খেলার বর্তমান অবস্থাটা
কী? কী হল শেষ পর্যন্ত। এ খেলা সমাপ্ত হয় কী করে? এটি কী করে সম্ভব যখন তাকে এ যাবৎ
খুঁজেই বের করা হয়নি?
এরপর তার
মনে হল, এ জায়গা থেকে অনেক আগেই সে বের হয়ে যেতে পারত। বারান্দায় পৌছে নিজেকে লুকিয়ে
রাখতে পারত, জয়ী হওয়ার জন্য এটার দরকার ছিল। এ ব্যাপারটি সে একেবারেই ভুলে
গিয়েছিল। সে শুধু মনে রেখেছিল নিজেকে লুকানো এবং যে খুঁজবে তার চোখ থেকে নিজেকে সরিয়ে
রাখার ব্যাপারটা । সফলতার সাথেই এটি সে সম্পন্ন করেছে। সে এতটাই এতে সফল হয়েছে যে
অন্যদের স্বীকারোক্তিমূলক হ্যা শব্দের চিৎকার শোনার আগ্রহও দেখায়নি।
কান্নায়
ফোঁপাতে ফোপাতে সে ফাঁক গলে বের হয়ে এসে হাঁটু চেপে বসে পড়ল । এরপর উঠে দড়িয়ে হোচট খেয়ে খোড়াতে
খোড়াতে এলোমেলো পায়ে ছায়াময় বাগান পার হয়ে কান্নাজড়িত স্বরে সাদা স্তম্ভযুক্ত
বারান্দায় উঠল। ডেন! ডেন! ডেন! চিৎকার ও কান্নার আবেগে তার গলা ভেঙে গেছে, দুঃখে ও বেদনায়
তার চোখ জলে পরিপূর্ণ।
বাইরের
উঠোনে ছেলেমেয়েরা তাদের গান বন্ধ করল। আর সবাই অবাক চোখে ওর। দিকে তাকিয়ে রইল।
সন্ধ্যার আবছা আলোতে ওদের সবার মুখ অস্পষ্ট আর ত্রিকোণাকৃতির মনে হচ্ছিল।
গাছপালা গুলোতে আঁধার জমাট বেঁধেছে, ঝোপঝাড়গুলো দীর্ঘ ছায়া ফেলেছে। ওরা সবাই রবির দিকে
তাকিয়ে তার আকস্মিক উদয় এবং আবেগ লক্ষ করছিল এবং বুনো জন্তুর মতো তার চিৎকার শুনছিল। ওদের
মা বেতের চেয়ার থেকে উঠে সামনে এগিয়ে এসে রাগতস্বরে ধমকে উঠল, থামো, থামো রবি,
তুমি এখন শিশু নও, তুমি কি নিজে নিজেই কোনো ব্যথা পেয়েছো? মাকে দেখে
ছেলেমেয়েরা তার কাছে চলে এল এবং একসাথে সবাই মিলে হাততালি দিয়ে গাইতে লাগল, ঘাস
হল সবুজ, গোলাপ হল লাল।
রবিও দমবার পাত্র নয়, মায়ের হাত ছাড়িয়ে
নিয়ে দ্রুত দৌড়ে বারান্দায় গিয়ে সবার সামনে উচুলয়ে বিজয়ীর ভঙ্গিতে বলতে
লাগল, আমি জয়ী হয়েছি, আমি জয়ী হয়েছি। সবাই অবাক হয়ে চারপাশে ছড়িয়ে গেল।
মাথার ঝাঁকুনি দিতে দিতে সে চোখের জলে ভিজে বলল, রঘু আমাকে খুঁজে পায়নি, আমি জয়ী,
আমি জয়ী ।
আসলে রবি কী
বলতে চাইছে এটা বুঝতে ওদের কিছুটা সময় লাগল। ওরা ওর কথা ভুলেই গিয়েছিল। রঘু অন্যদের অনেক
আগেই যুঁজে বার করেছে। এর পরবর্তীতে কে হবে এটা নিয়ে ঝগড়া শুরু হল। ঝগড়া এতটাই
মারাত্মক রূপ নিল যে, ওদের মা গোসলখানা থেকে বের হয়ে এসে এসব বন্ধ করে অন্য কিছু খেলার নির্দেশ
দিলেন।
এরপর ওরা
একটির পর আরেকটি খেলা খেলল, গাছ থেকে মালবেরি আহরণ করে তা ভেঙে খেল। ওদের বাবা ফিরে এলে
গাড়িচালকের সাথে গাড়ি ধোয়ামোছায় সহায়তা করল। বাগানের মালির সাথে ততক্ষণ পর্যন্ত
ওরা পানি দিতে সহায়তা করল যতক্ষণ পর্যন্ত না মালি ওদের পিতা-মাতার কাছে নালিশের ভয়
দেখাল। ওদের মা-বাবা বাইরে বেরিয়ে এসে বেতের চেয়ারে উপবেশন করল । তারা আবার গান
গাওয়া ও খেলা শুরু করল। এর মধ্যে ওরা কেউ রবির কথা মনে আনেনি। সবই দৃশ্যপট থেকে মুছে গেছে। এ ঘটনা
তারা সম্পূর্ণই ভুলে গেছে।
রঘু জোর করে
একপাশে তাকে ঠেলে দিয়ে বলল, আহাম্মকের মতো কথা বোলো না। মিরাও বললেন, চিৎকার থামাও রবি। রবি বলল, যদি আমাদের সাথে
খেলতে চাও তাহলে লাইনের শেষ প্রান্তে গিয়ে দাঁড়াও সে রবিকে ওখানে রাখার জন্য দৃঢ়
প্রতিজ্ঞ।
এগিয়ে চলল
খেলা। দু জোড়া হাত উঁচু হয়ে একত্রে একটি খিলানের মতো তৈরি করল। ছেলেমেয়েরা
গোলাকার বৃত্ত রচনা করে এর নিচ দিয়ে বারবার ঘুরতে লাগল গোল হয়ে আর মাথা নিচু করে মাঝে মাঝে বলতে
থাকল।
ঘাস হল সবুজ
গোলাপ হল
লাল
মনে রেখো
আমার কথা
যখন আমি
হারিয়ে যাব
হারিয়ে
যাব, হারিয়ে যাব
তখন আমায় মনে রেখো ।
গোধূলির ম্লান আলোয় সরু বাহুগুলো আন্দোলিত হতে
লাগল, মাথাগুলো নিচু হচ্ছিল বিষাদে, পাগুলো ওদের সুরেলা আওয়াজ তুলে ধীর লয়ে উঠানামা করছিল, কিন্তু
রবি এতে অংশ নিল না। সে তাদের অনুসরণও করল না। সে এমন বিষাদপূর্ণ খেলায় নিজেকে
যুক্ত করতে চাইল না। সে দুঃখ নয়, বিজয় কামনা করছিল। কিন্তু সবাই তার কথা ভুলে
গেছে, এজন্য ওদের সাথে সে যোগ দিচ্ছে না। সবার স্মৃতি থেকে সরে যাওয়ার এই গ্লানিকে সে কীভাবে মেনে নেবে? সে তার হৃদয়ে
তীব্র এক বেদনাভার অনুভব করল। সে লম্বা হয়ে সিক্ত ঘাসের উপর শুয়ে মুখ লুকাল, কান্নাকে
আর দীর্ঘস্থায়ী করল না, সীমাহীন এক ক্রোধ বুকে ধরে নীরব হয়ে রইল।
মারুফ, ঢাকা কলেজ
মারুফ, ঢাকা কলেজ
বাল লিখছে।। ঘটনার চাইতে অন্য বিষয়ের বর্ণনা বেশি।
ReplyDeleteMeaning less
ReplyDelete