একদিন এক জরুরী কাজের জন্যে রাজা গোপালকে ডেকে পাঠালেন। গোপাল বাড়ি ছিল না সে বাজার করতে গিয়েছিল। বাজার থেকে এসে শুনতে পেল রাজবাড়িতে রাজার হুকুম যে ঠিক সময়ে সভায় হাজির হওয়ার জন্য। রাজা ওদিকে গোপালের দেরি দেখে রেগে অস্থির হয়ে উঠেছিলেন। গোপাল আসা মাত্রই জড়া গলায় বললেন, ‘আমার হুকুম পেয়েও তুমি আসতে দেরি করো, আমায় তুমি অমান্য করতে শুরু করেছো তাহলে? আমার আর তোমাকে প্রয়োজন নাই।’
গোপাল করজোড়ে বললেন, ‘সে কি সর্বনেশে কথা প্রভু? আপনাকে অমান্য করবো, আপনার দাসানুদাস হয়ে? ব্যাপার কি জানেন আমি চাকরি করি দুটো। একটা হল রাজার আর একটা বৌয়ের। বৌয়ের বাজার না করলে রেগে ঢোল, আর তাহলেই রাজার বয়স্যগিরিতে গোল হয়ে যায়। যদি বৌকে আপনি মাথা মুড়িয়ে ঘোল ঢেলে দেশ থেকে বার করে দিতে পারেন, দিন মহারাজ! তাহলে ডাবল চাকরির ঝামেলা আর ধকল থেকে রেহাই পেয়ে আমি একমনে রাজসেবায় আত্ননিয়োগ করতে পারি। এ ছাড়া আমার কোনও উপায় নাই মহারাজ।’
গোপালের কথার ঢং দেখে রাজার রাগ উবে গেল; তিনি হো হো করে হেসে উঠলেন। সভায় আর সকলেই মহারাজের হাসিতে যোগ দিতে ভুল করল না।
2
একদিন গোপাল ও তার বন্ধু রাস্তা দিয়ে ভিন গায়ে যাচ্ছিল। যেতে যেতে দেখতে পেল একটা মিষ্টির দোকানে থালায় থালায় থরে থরে মিষ্টি সাজানো আছে। মিষ্টি দেখেই দুজনের জিভে জল এসে গেল।দু’জ পকেট হাতড়িয়ে দেখে মিষ্টি খাবার মত পয়সা পকেটে নেই। কিন্তু মিষ্টি না চেখে চলে যেতে তাদের পা উঠছেনা।তারা দুজনেই লোক সামলাতে পারলো না। সঙ্গে পয়সা না থাকলেও গোপাল ও গোপালের বন্ধু। পোশাক পরিচ্ছদের দিকে থেকে বেশ পরিপাটিই ছিল। দেখে বেশ বনেদী পয়সাওয়ালা ঘরের মনে হচ্ছিল।তখন ভর দুপুর। দোকানী ছাড়া আর কেউ ছিল না। গোপাল আর গোপালের বন্ধু আগে থেকে মতলব এটে নিয়ে দোকানে ঢুকে পড়ল। দুজনেই বেশ পেটপুরে যা ইচ্ছা সব রকম মিষ্টিই খেয়ে নিল। জাদরেল খদ্দের ভেবে দোকানদার একটু একটু করে কৃতার্থের হাসি হাসে।দোকানদার যখন দাম চাইলেন, তখন গোপাল বললেন, ‘আমি দিচ্ছি। কত দাম হয়েছে তোমার?’ গোপালের বন্ধুটি বললেন, না, ‘আমি দিচ্ছি, কত দাম বল।’ দু’জনের মধ্যে দাম দেওয়া নিয়ে দস্তুরমতো রেবারেবি শুরু হয়ে গেল। গোপাল দাম দিতে যায়, তার বন্ধুটি বাধা দেয়বন্ধুটি দাম দিতে এগোয়, গোপাল বাধা দেয়। না তুমি দেবে না, আমি দেব এই বলে দু’জনের মধ্যে কে আগে দেবে এই মনোভাব যেন। দোকানী এই সব দেখে হেসে লুটোপটি। পরিশেষে, গোপাল দোকানীকে বললেন, মশায়, আপনার কাঁধের গামছাখানা দিয়ে আপনার চোখ বেধে দিচ্ছি। আপনি চোখ বাধা অবস্থায় আমাদের দু’জনের মধ্যে যাকে প্রথমে এসে ধরবেন সেই খাবারের দাম দেবে। বলুন রাজী আছেন?দোকানী গোপালের প্রস্তাবে রাজী হয়ে গেল। গোপাল দোকানীর কাধের গামছাখানা দিয়ে তার কোছ দুটোকে কষে বেধে দিলেন। তারপর গোপাল আর গোপালের বন্ধু দোকান থেকে তাড়াতাড়ি আরও কিছু মিষ্টি তাদেরই জায়গায় বেধে নিয়ে কেটে পড়ল। দোকানী দু’হাতে এদিক ওদিক করে যেতে লাগল।বেশ কিচুদুর চলে আসার পর গোপালের বন্ধুটি গোপালকে বলল, ‘অনেকদিন পরে বেশ কানামাছি খেললে তো। গোপাল বন্ধুর কথা শুনে মুচকি হেসে বললেন আমি আর কানামাছি খেললুম কোথায়? দোকানী ব্যাটা এখনও বোধ হয় খেলছে। তারপর দু’জনে হাসতে হাসতে জোরে জোরে পা চালিয়ে পগারপার। যদি পেছনে এসে পড়ে.
3
বর্ধমানের রাজসভাতেও এক ভাড় ছিল। নাম তার নেপাল। সে সকলের কাছে বলত গোপালের চাইতে তার বুদ্ধি অনেক বেশি, গোপালকে একবার সামনে পেলে সে তাকে বোজা বানিয়ে দিতে পারে কি না পারে, দেখা যাবে একবার। দৈবক্রমে একসময়ে গোপাল মহারাজের দরবার থেকে বর্ধমান রাজসভায় গিয়ে উপস্থিত। বর্ধ্মান রাজ যখন শুনলেন গোপাল এসেছে, তখন তিনি খুশি হয়ে বললেন, ‘তুমি এসেছ, বড় ভাল হয়েছে। আমার ভাড়টি সর্বদাই তোমার সঙ্গে প্রতিযোগীতা করবার ইচ্ছা প্রকাশ করে থাকে। এবার প্রমাণ হবে সে বড়, না তুমি বড়। প্রতিযোগীতায় তুমি আমার ভাড়কে বুদ্ধিতে হারাতে পারলে আশাতীত পুরস্কার পাবে।’ নেপালের সঙ্গে এটে উঠতে পার কিনা দেখি। সে জিতলে সেও পাবে।’
গোপাল ঈষৎ হেসে বললেন, ‘হুকুম করুন, কি করতে হবে।’
রাজা বিচারের ভার দিলেন মহামন্ত্রীর উপর। বিজ্ঞ মহামন্ত্রী গোপাল এবং বর্ধমানের ভাড় নেপাল দুজনকে ডেকে বললেন, ‘তোমরা প্রত্যেকেই তিনজন করে লোক সংগ্রহ করবে ও তাদের কাল সকালে রাজসভায় হাজির করবে। ওই তিনজনের ভিতর একজন হবে দরিয়ার এ পারের লোক, একজন ও পারের, আর একজন মাঝ দরিয়ার লোক।’
‘যে আজ্ঞে।’ বলে গোপাল এবং বর্ধমানের ভাড় নেপাল দুজনেই বিদায় নিলেন। নেপাল ভাবল এবার আমি গোপালকে ঠকাবই ঠকাব, সে মুচকি হেসে নাচতে নাচতে বিদায় নিল। নেপাল পরদিন ভোরে নদির ঘাটে গেল। সেখানে দাড়িয়ে নদীর এপার থেকে একজন, নদীর ওপার থেকে একজন এবং মাঝনদীর নৌকার উপর থেকে একজন লোককে ডেকে আনলে রাজার নাম করে এবং তাদের সভায় এনে হাজির করলে। তিনজন লোক ত ভয়ে অস্থির।
আমরা কোন দোষ করিনি বাবু, আমাদের কেন রাজসভায় নিয়ে এলেন।’ আমাদের কি দোষ ধরে নিয়ে এলো?’
গোপালও যথাসময়ে রাজসভায় এসে হাজির হলো, তারও সঙ্গে তিনজন লোক, একজন তার ভিতর ভটচাজ ঠাকুর, একজন সন্ন্যানী, একজন নারী। তাদের নিয়ে সে সভার একপাশে চুপ করে বসে রইল। বর্ধমানের ভাড় রাজা ও মন্ত্রীকে সম্বোধন করে বললে ‘হুকুম মত আমি এই তিনজন লোককে এনে হাজির করেছি। প্রথম লোকটি ছিল নদীর এপারে, দ্বিতীয় লোকটি ছিল নদীর ওপারে, এই তৃতীয় লোকটি মাঝ নদীতে নৌকার ওপরে ছিল। যদি বিশ্বাস না হয় এদেরকে জিজ্ঞাসা করে দেখুন আমি সত্যি বলছি, না মিথ্যা বলছি ওরাই সে কথা বলবেন।’
তারপর গোপালকে বলা হল, সে যাদের এনেছে, তাদেরকে সামনে উপস্থিত করার জন্য। গোপাল জানাল, এদেরকে বহুকষ্টে অনুনয় বিনয় করে রাজসভায় উপস্থিত সে করেছে। কেউই প্রথমে রাজসবায় আসতে চায়নি। বিশেষ করে সন্ন্যাসী ঠাকুর কোনমতেই রাজসভায় আসতে নারাজ । গোপালের কথাবার্তায় সন্তুষ্ট হয়ে উনি রাজি হয়েছেন। পরিচয় বোর জন্য গোপাল কর যোড়ে নিবেদন করলে, ‘মহান মহারাজ। মহামান্য মহামন্ত্রী এবং সভাসদগণ। এই যে তিনজনকে আমি রাজসভায় নিয়ে এসেছি, এরা কেউ আজ দরিয়া বা নদির দিকে যান নি। কারণ আমার মনে হয়নি যে সুবিজ্ঞ মহামন্ত্রী দরিয়া বা ‘নদী’অর্থে বলতে সামনের গঙ্গানদী বুঝিয়েছেন। আমি অন্তত মহামন্ত্রীর নদী অর্থে এখানে বুঝেছি ভব (জীবন) নদী। আমার অনুমান অভ্রান্ত মনে করে তাই এপার ওপার ও মধ্যস্থানের এক একটি লোক এনে রাজসভায় বহুকষ্টে হাজির করেছি।’
‘এই যে ভটচাজ ঠাকুর ইনি চাইছেন কি করে দেশে এর পাণ্ডিত্যের খ্যাতি দিন দিন ছড়িয়ে পড়বে, কি করে বেশ দু’পয়সা উপার্জ্ন হবে, কি করে যশে মানে ধনে ইনি দেশও দশের ভিতরে একজন মহামান্য হয়ে উঠতে পারবেন। সম্পূর্ণ্ভাবে ইহ-কাল নিয়েই ইনি ব্যস্ত আছেন। এক কথায় বলা যায়, ইনি এ পারের লোক। এ পারের লোক এ ধরনের ছাড়া আমার অন্য কাউকে মনে হয় না।
………আর এই যে সন্ন্যানী ঠাকুর, ইনি ইহকাল নিয়ে মাথা ঘামান না মোটেই। সর্বদায় সৃষ্টিকর্তার ধ্যানে বিভোর, কি করে সৃষ্টিকর্তার কৃপা লাভ করবেন সেই নিয়ে তম্ময়, খেতে দিন খাবে খেতে না দিন খাবে না, সুতরাং এদরকেই বলা যায়, ও পারের লোক।
…… আর ওই যে তৃতীয়টি, ও হল এই নগরের একটি বেশ্যা। বেশ্যা ইহকালের কথাও ভাবে না, পরকালের কথাও বাবে না। সে ইহকাল-পরকাল বলতে কিছুই বোঝে না। সে এ পারের লোকও নয়, ও পারের লোকও নয়। অর্থাৎ সে মাঝ নদির লোক। এই আমার তিনজন লোকের পরিচয়। মহামন্ত্রীর আদেশমত কাজ করতে পেরেছি কিনা, এইবার সভা তা যাচাই করুন। আমার আর এর বেশি বলার কিছুই নেই। আপনারা সকলেই ভেবে বিচার করে দেখুন। ঠিক হয়েছে কিনা। সেটা আপনাদের উপর ছেড়ে দিলাম।’
সভায় ধন্য ধন্য রব উঠল। রাজা মহামন্ত্রী বললেন, ‘গোপালের মত বুদ্ধিমান লোক ভাড়েদের ভেতর দূরের কথা বড় বড় পণ্ডিত সমাজে দুর্ল্ভ। নেপালের অহঙ্কার সেদিন থেকে দূর হয়ে গেল। রাজা এবার গোপালকে প্রচুর পুরস্কার সহ বিদায় দিলেন। গোপাল শুধু সুরসিক ভাড় নয় শুভ বুদ্ধিসম্পন্ন মহাপণ্ডিতও বটে দিকে দিকে তার এই গুণের কাহিনী ঘোষিত হল। কৃষ্ণনগরে মহারাজ ও গোপালের এই কাহিনীগুলোর গুণের কদর করতে ভুললেন না। সেদিন থেকে নেপাল গোপালের বন্ধু হয়ে গেল।
রাজাকৃষ্ণচন্দ্র একবার পেয়াদাকে ডেকে বললেন, ওরে ভজহরি ব্যাপারীকে একবার ডেকে আনবি তো। ভজহরি সরেস গুড়ের কারবার করত। পেয়াদা ব্যাপারীকে একেবারে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাজসভায় হাজির করলে। ভজহরি গোপালকে ধারে মাল দিতে চাইত না, তাই তার ওপর গোপাল চটে ছিল। পেয়াদা তাকে আজ একেবারে রাজসভায় বেঁধে এনেছে বলে গোপাল মনে মনে বেশ খুশিই হল। বলল,- বেশ হয়েছে শালাকে বেধেই এনেছে।
রাজা কিন্তু পেয়াদার ওপর চটে গিয়ে বললেন, আমি ভজহরিকে ডেকে আনতে বললুম, আর তুই কিনা একেবারে বেধে নিয়ে এলি? তোকে আমি বরখাস্ত করব। তোর বেশ বাড় হয়েছে, কেন তুই বেধে এনেছিস- আগে কৈফিয়ত দে, নয়তো এখনি তোকে বরখাসত করলাম। তোর কিছু বলার থাকে বল।পেয়াদা কাঁদতে কাঁদতে বলল, আর করব না হুজুর। এবোরের মত বেয়াদপি মাপ করুন। নাহলে খেতে না পেয়ে মরে যাবো।
গোপাল পেয়াদা পক্ষ নিয়ে ওকালতি করে মোলায়েম স্বরে বললে, হুজুর একে বরখাস্ত করবেন না- এ হচ্ছে জাত পেয়াদা। পেয়াদারা ধরে আনতে বললে বেধেই আনে – আর এ ডেকে আনতেই বলায় বেধে আনায় প্রকৃত পেয়াদার মতোই কাজ করেছে। যদি জাত পেয়াদা না হত সে কখনই বেঁধে আনত না। কথাটা ঠিক কিনা এবার মহারাজ আপনি বিবেচনা করে দেখুন।
গোপালের কথায় রাজা হেসে ফেললেন এবং অতি করিৎকর্মা পেয়াদাকে ক্ষমা করে দিলেন সেবারের মত। বললেন, এবারের মত অবশ্য মাপ করলাম, আর যেন কখনও এমন না হয় মনে রাখবি।
রাজাকৃষ্ণচন্দ্র একবার পেয়াদাকে ডেকে বললেন, ওরে ভজহরি ব্যাপারীকে একবার ডেকে আনবি তো। ভজহরি সরেস গুড়ের কারবার করত। পেয়াদা ব্যাপারীকে একেবারে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাজসভায় হাজির করলে। ভজহরি গোপালকে ধারে মাল দিতে চাইত না, তাই তার ওপর গোপাল চটে ছিল। পেয়াদা তাকে আজ একেবারে রাজসভায় বেঁধে এনেছে বলে গোপাল মনে মনে বেশ খুশিই হল। বলল,- বেশ হয়েছে শালাকে বেধেই এনেছে।
রাজা কিন্তু পেয়াদার ওপর চটে গিয়ে বললেন, আমি ভজহরিকে ডেকে আনতে বললুম, আর তুই কিনা একেবারে বেধে নিয়ে এলি? তোকে আমি বরখাস্ত করব। তোর বেশ বাড় হয়েছে, কেন তুই বেধে এনেছিস- আগে কৈফিয়ত দে, নয়তো এখনি তোকে বরখাসত করলাম। তোর কিছু বলার থাকে বল।পেয়াদা কাঁদতে কাঁদতে বলল, আর করব না হুজুর। এবোরের মত বেয়াদপি মাপ করুন। নাহলে খেতে না পেয়ে মরে যাবো।
গোপাল পেয়াদা পক্ষ নিয়ে ওকালতি করে মোলায়েম স্বরে বললে, হুজুর একে বরখাস্ত করবেন না- এ হচ্ছে জাত পেয়াদা। পেয়াদারা ধরে আনতে বললে বেধেই আনে – আর এ ডেকে আনতেই বলায় বেধে আনায় প্রকৃত পেয়াদার মতোই কাজ করেছে। যদি জাত পেয়াদা না হত সে কখনই বেঁধে আনত না। কথাটা ঠিক কিনা এবার মহারাজ আপনি বিবেচনা করে দেখুন।
গোপালের কথায় রাজা হেসে ফেললেন এবং অতি করিৎকর্মা পেয়াদাকে ক্ষমা করে দিলেন সেবারের মত। বললেন, এবারের মত অবশ্য মাপ করলাম, আর যেন কখনও এমন না হয় মনে রাখবি।
No comments:
Post a Comment