সে অনেক অনেক কাল আগের কথা।কোন এক গ্রামে বাস করতো দুই বন্ধু। একজন ওয়ালিদ, অন্যজন ওয়াফী। মুখোমুখি ঘর দু’জনের।গ্রামের সবাই তাদের বন্ধুত্বের কথা জানতো । আর এক বুড়ো ছিল। সে অনেক জ্ঞানী ছিল। একবার সে ওয়ালীদ আর ওয়াফিয়ের বন্ধুত্ব পরখ করে দেখতে চাইলেন ।দুই বাড়ির মাঝে ছিলো পায়ে হাঁটা এক পথ। এক সকালে ওই পথ দিয়েই যাচ্ছিলেন বুড়ো। মাথায় একটা নতুন টুপি। টুপিটার একপাশ লাল, অন্যপাশ সবুজ।প্রথমেই দেখা হলো ওআলীদের সঙ্গে। নিজেদের জমিতে লতানো গাছের পরিচর্যা করছিলো সে।বুড়ো বললেন, ‘শুভ সকাল, ওয়ালীদ।’ওয়াফী বললো, ‘শুভ সকাল। খুব সুন্দর লালটুপি পরেছেন দেখছি।’বুড়ো বললেন, ‘ধন্যবাদ। টুপিটা সুন্দর হয়েছে জেনে খুশি হলাম।" ওয়াফী বললো, ‘সত্যিই খুব সুন্দর টুপিটা।’টুপিটা নেড়েচেড়ে একটু ঠিকঠাক করে আবার হাটতে শুরু করলো বুড়ো। কিছুক্ষণ পর দেখা হয়ে গেলো ওয়ালিদের সঙ্গে। ওয়ালীদ তখন জমির আগাছা পরিষ্কার করছিলো।বুড়ো লোকটি তখন হাঁক দিলেন, ‘শুভ সকাল, ওয়ালীদ'। ওয়ালীদ ঘুরে তাকালো জ্ঞানী বুড়োর দিকে। নতুন টুপিটা তারও চোখ এড়ায়নি। বললো, ‘ওহ্! কী সুন্দর সবুজ রঙের টুপি পরেছেন। নতুন ?’মুচকি হেসে বুড়ো বললেন, ‘এই আর কি। এমন একটা টুপির শখ অনেকদিন থেকেই ছিলো। সে যাই হোক। তারপর বলো, কেমন আছো তুমি?’ওয়ালীদের সঙ্গে কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে চলে গেলেন বুড়ো।একসময় সূর্যটা চলে এলো একেবারে মাথার ওপর। দুপুরের খাবারের সময় হয়ে গেছে। কাজ বন্ধ করে ওয়ালীদ গেল তার বন্ধু ওয়াফীর কাছে। প্রতিদিন দু’জন একসঙ্গে দুপুরের খাবার খায়। খেতে খেতেই ওয়াফী জানতে চাইলো, ‘আমাদের প্রতিবেশী বুড়োর নতুন লাল টুপিটা দেখেছো? খুব সুন্দর, তাই না?’অবাক হয়ে ওয়ালীদ বললো, ‘লাল! তুমি লাল কই দেখলে, সবুজ টুপিটাকে তুমি লাল কেন বলছো? টুপিটা তোমার কাছে হয়তো লাল মনে হয়েছে। আসলে সূর্যের ঝকমকে আলো তোমার চোখে ধাঁধা লাগিয়ে দিয়েছে।’ওয়াফী বললো, ‘মানে! তুমি কী বলতে চাইছো?’বন্ধুর বোকামীতে একটা ব্যঙ্গ হাসি দিলো ওয়ালীদ, আর বললো, ‘আমাদের প্রতিবেশী বুড়োর মাথায় লাল টুপি দেখিনি বন্ধু। সবুজ টুপি দেখেছি।’ওয়াফী বললো, ‘সবুজ টুপি! ওহ্, বন্ধু আমার, উল্টাপাল্টা কী বলছো বুঝতে পারছি না! ওটা সবুজ টুপি ছিলো না। লালই ছিলো। আমি ভালোমতো দেখেছি।’গলা চড়িয়ে ওলেলে বললো, ‘উঁহু। আমিই ঠিক বলছি। ওটা সবুজ ছিলো।’বন্ধুর চড়া গলা শুনে বিরক্ত হলো ওয়াফী। গলা চড়ালো সে-ও, ‘আমিই ঠিক দেখেছি। টুপিটা লালই ছিলো’এবার রেগে গেলো ওয়ালীদ ও।
চেঁচিয়ে উঠলো, ‘টুপিটা সবুজই ছিলো।’তারপর টুপির রঙ নিয়ে শুরু হলো দু’জনের মধ্যে চিৎকার আর চেঁচামেচি। খানিকপর ঝগড়া।
আরও খানিকপর বিষয়টা আর ঝগড়াতেই আটকে রইলো না, হাতাহাতিতে
গিয়ে ঠেকলো। ওদের হাতাহাতি আর চিৎকার শুনে জড়ো হতে লাগলো অন্য প্রতিবেশীরা। একটু
পর ওদের প্রতিবেশী সেই বুড়ো ভিড় ঠেলে এগিয়ে এলেন দু’জনের কাছে। জানতে চাইলেন, ‘ কী হচ্ছে এসব? দুই
বন্ধু মারামারি করছো? অথচ আমি তো ভেবেছিলাম তোমরা খুব
ভালো বন্ধু। তোমাদের বন্ধুত্বের নমুনা এই? ছিঃ ছিঃ ছিঃ!’মাঝপথে বাধা পেয়ে থেমে গেলো ওয়ালীদ আর ওয়াফী। চোখ বড় বড় করে
তাকালো বুড়োর দিকে। ঠিক তখনই টুপিটার সবুজ দিকটা ওয়াফীর আর লাল দিকটা ওয়ালীদের
চোখে পড়লো।সঙ্গে সঙ্গে ওয়ালীদ বললো, ‘বন্ধু ওয়াফী, আমি আসলেই দুঃখিত। তুমি ঠিক
কথাই বলেছিলে তখন। আমাদের প্রতিবেশীর টুপিটা সত্যিই লাল।’সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করে উঠলো ওয়াফী, ‘না, না, তুমি ভুল বলোনি। না জেনে ভুল কথা আমিই বলেছিলাম। সূর্যের চিকচিকে আলোয়
আমার চোখে তখন ধাঁধা লেগেছিলো। সে জন্যই আমাদের প্রতিবেশীর সবুজ টুপিটাকে লাল
দেখেছিলাম।’ওয়ালীদ
বললো, ‘উঁহু।
তুমিই ঠিক বলেছিলে। টুপিটা আসলেই লাল।’ওয়াফী বললো, ‘না। তুমিই ঠিক বলেছিলে, সত্যি সত্যি
টুপিটা সবুজ।’তারপর
আবার শুরু হলো দু’জনের
চেঁচামেচি, হৈচৈ, ঝগড়া। দু’জনের ঝগড়া দেখে না হেসে পারলেন না বুড়ো। হাসতে
হাসতেই মাথা থেকে টুপিটা খুলে দেখালেন, ‘দেখোতো এটা। টুপির ব্যাপারে কারোরই ভুল ছিলো না।
কিন্তু বন্ধুত্বের ব্যাপারে তোমরা কেউই ঠিক নও। আসলে এখনও তোমরা কেউ কারও সেরা
বন্ধু হতে পারোনি। টুপির রঙ নিয়ে দু’জনই হৈচৈ করেছো, চেঁচামেচি করেছো,
রাগারাগি করেছো, এমনকি মারামারিও করেছো।
তোমরা কেউই ঠাণ্ডা মাথায় যাচাই করে দেখোনি, কার কথাটা
ঠিক। নিজের দেখাটাকেই সঠিক হিসেবে চাপিয়ে দিতে চেয়েছো। টুপি, টুপির রঙ এসব কিছুই তোমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিলো না। গুরুত্বপূর্ণ
ছিলো নিজের কথা।’ওয়ালিদ বললো, ‘আপনি
ঠিকই বলেছেন। আসলে যাচাই ছাড়া কেউই বুঝতে পারে না, কার
বন্ধুত্ব কতোখানি। টুপিটা লাল নাকি সবুজ, সেটা এখন আমার
কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়_ ওয়াফীর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব
কতোখানি_ সেটাই গুরুত্বপূর্ণ।’সঙ্গে সঙ্গে ওয়াফীও সমর্থন জানালো বন্ধু ওয়ালীদের
কথায়, ‘আমার
কাছেও।’এরপর থেকে তাদের বন্ধুত্ব হয়েছে
আরও গভীর।
No comments:
Post a Comment